রুবাই’ শুধু কবিতা নয়, যেন শত শত কবিতার সংকলন। ওমর খৈয়ামের রুবাই’ পড়লে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। কিন্তু কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করেন যে, রুবাই’ এর একটি লাইনও ওমরের লেখা নয়। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই রুবাই’কে ওমরের কবিতা বলে উল্লেখ করেছেন। রুবাই’তে প্রায় ২,০০০ চতুষ্পদী কবিতা আছে, যেগুলোর সব বর্তমানে পাওয়া যায় না। তবে সর্বনিম্ন সংখ্যাটি বলা হয় যে, ওমর প্রায় ১,২০০ এর মতো চতুষ্পদী কবিতা লিখেছেন।
“আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা”- উনিশ শতকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই কবিতা লিখেছিলেন। আর ওমর খৈয়াম প্রায় হাজার বছর আগেই এই কবিতার বাণী নিজের জীবনে প্রতিফলিত করেছিলেন। পিতা এবং পিতৃতুল্য শিক্ষকের মৃত্যুতেও ভেঙে না পড়ে সংসারের হাল ধরেন। তিনি ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে, পারস্যের বিখ্যাত বাণিজ্যিক শহর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তখন ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ আর সে যুগ ছিল সকল প্রকারের গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা বিবর্জিত। মুসলমানরাও ছিল মুক্তমনা ও জ্ঞানপিপাসু। ওমরের বাবা ইব্রাহিমও তেমনই একজন মুসলিম ছিলেন, যিনি ছেলের জন্য জরাথ্রুস্টর ধর্মে বিশ্বাসী এক শিক্ষক বামান্যর বিন মারযবানকে নিয়োগ দেন। এই বামান্যরই কিশোর ওমরকে গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষা দেন। ইবনে সিনার ছাত্র বামান্যরের কাছেই ওমর খৈয়াম ইবনে সিনার দর্শন শিক্ষা লাভ করেন। সব কিছুই চলছিল ঠিকঠাকভাবে। তবে আঠারোতে পা দিতেই যেন পা পিছলে পড়তে হলো ওমরকে। ১০৬৬ সালে, অর্থাৎ যে বছর ওমর আঠারো বছরের কিশোর, সে বছরই তার পিতা এবং শিক্ষক উভয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে, সে বছর একটি মহামহিম ঘটনা ঘটে। বছরের শেষ দিকে আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হ্যালির ধূমকেতু, যা দেখে ওমরের মনের ডালপালাতে ছড়িয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের কৌতূহল।
মানুষের শক্তির দম্ভ ও ঐশ্বর্য কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এ জগতে মানুষের আস-যাওয়া নিতান্তই অর্থহীন। আমরা কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি, আবার কোথায় চলে যাবো- মানব জীবনের এই চির-পুরাতন ও চির-নতুন রহস্য উন্মোচিত ও উদঘাটিত করবার প্রয়াস পেয়েছিলেন ওমর খৈয়ম। তার মতে, “কোন এক অন্ধকার লোক থেকে মানুষ এ জগতে আবির্ভূত হয়, তারপর স্বল্পকালের জন্য খেলা খেলে আবার মহাকালের কোলে বিলীন হয়ে যায়। “মহাকালের ভাবনা ওমরকে দারুণভাবে নাড়া দিতো। আর তাই, তার রুবাই’তে উঠে আসে জীবন-মৃত্যুর চিরাচরিত বাস্তব অনুভূতিগুলো।
জন্মসূত্রে মানুষ নিয়তির নাগপাশে বন্দী। নিয়তি মানুষের সুখে-দুঃখে সমনির্বিকার। তাকে খন্ডন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বৃথা হা-হুতাশ করে কি লাভ? কবির মতে জীবনটা যেন একটা পুতুল খেলা। তিনি ভাবেন, মানুষ অদৃষ্টের হাতে ক্রীড়নক মাত্র। নিয়তি-তাড়িত মানুষ যেন নিয়তিরূপী দাবার ঘুঁটি। “আমরা দাবা খেলার ঘুঁটি, নাই রে এতে সন্দ’ নাই! আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই। এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব, খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মুত্যু বাক্সে ভাই!” (রুবাই’ ১৬২)
এক প্রতাপশালী সম্রাট বাহ্রামের জলসা ঘরে হরিণ বিহার করতো, বাঘেরা সেথায় আরাম করে ঘুমতো, একজন নিপুণ শিকারী হয়ে সে একদিন মৃত্যুর হাতে শিকার হন। কবি বলেন, “এই সে প্রমোদ-ভবন যেথায় জলসা ছিল বাহ্রামের, হরিণ যেথায় বিহার করে, আরাম করে ঘুমায় শের! চির জীবন করল শিকার রাজ-শিকারী যে বাহ্রাম, মৃত্যু-শিকারীর হাতে সে শিকার হল হায় আখের!” (রুবাই’ ৯৫)
প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, বর্ণ, স্পর্শে আমাদের অভিভূত ও আবেগ বিহ্বল হওয়ার কোন হেতু নেই। কারণ, মানব জীবনে প্রকৃতি আশ্চর্য রকমের ছলনাময়ী। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মাধুর্যে মানুষ মুগ্ধ ও মোহিত। অথচ প্রকৃতি কি নিষ্ঠুর! শাহানশা’র রক্তের উপর ফুঁটে উঠে গোলাপ ফুল, গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর, তার উপরই ফুটে উঠে নার্গিস। আর সে উদ্দেশ্যে ওমর বললেন, “দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়, জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোন শাহানশা’র রুধির। নার্গিস আর গুল-বনোসা’র দেখবে যেথায় সুনীল দল, ঘুমিয়ে আছে সেথায় গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর।” (রুবাই’ ২২)
পাপ-পূণ্যে সমান উদাসীন কবির কাছে, জীবনে মানুষের দুঃখ ও দাহ হল নরক আর সুখ ও শান্তিই স্বর্গ বলে প্রতিভাত। কবির মতে, “বুকের কুন্ডে দুখের দাহ তারেই আমি নরক কই, মুহূর্তের যে মনের শান্তি আমি বলি স্বর্গ তায়।” (রুবাই’ ৮৮)
কবির মন্তব্য, স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে আসার ব্যাপারে স্রষ্টা তাঁর মত নিলে তিনি কিছুতেই আসতেন না। সম্ভব হলে আসা যাওয়ার রীতিটাই বন্ধ করে দিত। কবি বলেছেন, “স্রষ্টা যদি মত্ নিত মোর আসতাম না প্রাণান্তেও, এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছে নেই মোটেও। সংক্ষেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে যাওয়া-আসা জন্ম আমার, সেও শূন্য শূন্য এও।” ( রুবাই’ ১৩)
আরিফুর রহমান (সম্পাদক, অচিনপুর.কম)
…….:::::::: চলবে :::::::……..
অন্যান্য পর্বসমূহ পড়ুন: পর্ব-৫: রুবাইয়াৎ মানে কাব্য যাদু, পর্ব-৩: রুবাইয়াৎ মানে কাব্য যাদু, পর্ব-২: রুবাইয়াৎ মানে কাব্য যাদু, পর্ব-১: রুবাইয়াৎ মানে কাব্য যাদু