নীলক্ষেতের পুরনো বই

অমিতা মজুমদার
ঢাকা।

গল্পঃ নীলক্ষেতের পুরোনো বই

মেয়ের পড়ার টেবিল গুছাচ্ছিল অনু। এতো অগোছালো মেয়ে তার। আবার টেবিল গুছিয়ে রাখলে রাগ করে। সে নাকি গোছানো বইয়ের মধ্য থেকে দরকারের বই খুঁজে পায় না। তবুও মাঝে মাঝে অনু মেয়ের অগোচরে টেবিল গুছিয়ে রাখে। সেরকমই আজ গুছিয়ে রাখছিল। কোন বই খোলা, কোনটা আধখোলা, যেন একটু আগে এখানে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে।
একটা বই হাতে নিল অনু। আনমনে বইটার পাতা ওল্টাচ্ছিল সে। হঠাৎ বইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা ভাঁজ করা কাগজ। অন্যায় জেনেও কাগজটা খুলল। দেখে মনে হলো একটা চিঠি।একটু অবাক হয়েই সে চিঠিটা না পড়ে দেখছিল। কারণ আজকাল তো কেউ চিঠি লেখে না। মূঠোফোনে কথা বলা যায় যখন তখন, মন চাইলে দেখাও যায়। আরো কিসব আছে, মেসেজ করা, যা চিঠি ও কথা বলার বিকল্প ব্যবস্থা বলা যায়।
খানিক নেড়েচেড়ে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করল কেমন একটা যন্ত্রচালিতের মতো। পড়তে পড়তে পরিচিত একটা গন্ধ পায় চিঠিটায়। লেখাগুলো কেমন ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।
চোখদুটো একটা লাইনে এসে থেমে যায়। এ কি করে সম্ভব! সে চিঠিটার উপরে লেখা তারিখ দেখে চমকে ওঠে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের তারিখ। বইটা হাতে তুলে নেয়। এটা তো সেই তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ প্রথম খন্ড। খোকা ভাইকে তার বিশতম জন্মদিনে অনু কিনে দিয়েছিল, নিউমার্কেটের বুক সিন্ডিকেট লাইব্রেরী থেকে। নিজের হাতে গোটা গোটা অক্ষরে খোকাভাইয়ের নাম লিখেছিল। নীচে খুব ছোট্ট করে লিখেছিল অনু। সে সময় এখনকার মতো ঘটা করে জন্মদিন যেমন কেউ পালন করত না, আবার একেবারে নিকট আত্মীয় ছাড়া উপহার দেয়াটাও কেউ ভালো চোখে দেখত না। তাও যদি হয় আবার দুটি তরুণ বয়সের ছেলেমেয়ে।
সেই প্রথম কলেজ হোষ্টেল থেকে খোকা ভাইয়ের সাথে নিউমার্কেট গিয়েছিল অনু। খোকাভাই বলছিল তোর ভয় করছে না, এই যে একা একা আমার সাথে মার্কেটে যাচ্ছিস? যদি কেউ দেখে ফেলে আর বাড়িতে গিয়ে বলে দেয়!
অনুর মেয়েটার অভ্যাস আছে নীলক্ষেত থেকে রাজ্যের পুরনো বই কিনে আনার। সে রকমই হয়তো এ বইখানাও এনেছে। খোকাভাই হয়তো তখন যত্ন করেই চিঠিখানা রেখেছিল বইয়ের মধ্যে। তারপর আর মনে করার সময় হয়নি হয়তো, বা সময় পায়নি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাসখানেক আগেই অনুকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তার বাবা। তারপরে আর খোকাভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি অনুর।
অনু শুনেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যখন যায় খোকাভাই তার বইখাতা, বিছানাপত্র ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে এসে খোকাভাই যেন কেমন বদলে যায়। নিজের গ্রামে গিয়ে যখন শোনে যুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে কেমন নৃশংসভাবে তার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়। আদরের ছোট্ট বোন প্রায় কিশোরী সুইটি হারিয়ে যায় রাতের আঁধারে। অর্ধউন্মাদ মাকে নিয়ে সেই যে খোকাভাই শহরে যায়। আর তেমন পরিচিত কারও সাথে যোগাযোগ করে না। অনু একে ওকে ধরে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মহানগরের এই জনারণ্যে কেউ যদি ইচ্ছা করে হারিয়ে যায় তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়?
অনুও নতুন ভাবনায় নতুন জীবনে থিতু হয়। আর পাঁচটা সংসারী মেয়ের মতো সেও সংসারটাকেই ভালোবেসে সময় পার করে।
একসময় শুনেছে খোকাভাই মায়ের মৃত্যুর পর বিদেশে চলে গেছে। সেখানেই সে সংসারী হয়েছে। এখন নাকি মাঝে মাঝে দেশে আসে। গ্রামে বড় মসজিদ, মাদ্রাসা করেছে। এছাড়া নানারকম ধর্মীয় উৎসব আয়োজনে প্রচুর দান খয়রাত করে।
চিঠিটা আবার উলটে পালটে দেখে অনু। হ্যাঁ! সেই চিঠিটাই তো! একটা সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে কেমন কল্পনার জাল বুনেছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ যেন এই চিঠিখানা। সেবার এস এস সি পরীক্ষার আগে বড়দাদা তাকে একটা পাইলট কলম দিয়েছিল। সেই কলম দিয়ে ফুল আঁকা রঙ্গিন কাগজে সে লিখেছিল চিঠিখানা। কতো কষ্ট করে লুকিয়ে চিঠিখানা দিয়েছিল খোকাভাইকে। কি ছেলেমানুষ ছিল সে, নইলে অমন কথা কেউ চিঠিতে লেখে! কি জানি খোকাভাই আদৌ চিঠিখানা পড়েছিল কিনা। নাকি তার ছেলেমানুষী ভেবে আনমনে দেখেও পরে পড়বে ভেবে রেখে দিয়েছিল? এতো বছরের পুরনো কাগজখানা হাতের মধ্যে কখন গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় অনু টেরও পায় না।

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation