দুঃস্বপ্ন

শামীম রেজা
ক্যালিফোর্নিয়া।

গল্প: দুঃস্বপ্ন

আমার স্ত্রী রুপার ডাক্তার দেখানোর বাতিক আছে। তাও সাধারন ডাক্তার হলে চলবে না, শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তার হতে হবে এবং অতি অবশ্যই স্পেশালিস্ট। কারন তার কোন সাধারন অসুখ হয় না। কোমরে ব্যথা হলে তার প্রথমেই মনে হয় কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে, বুকে চিনচিন ব্যথা মানেই হার্টের সমস্যা। গলায় ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে, তার মানে হলো থ্রোট ক্যান্সার হয়েছে। তাকে যেন ইএনটি স্পেশালিস্ট দেখানো হয়। আমি তোড়জোড় করে ডাক্তার খোঁজা ও এপয়নমেন্ট নেয়ার ভান করি। দুদিন পরে এমনিতেই সিম্পটম চলে গেলে আর সাধারন বা অসাধারন কোন ডাক্তারই দেখাতে হয় না।

কাজেই উইকেন্ডের সকালে চা খেতে খেতে রুপা যখন বললো যে সে একজন সাইকিয়ারটিস্ট দেখাতে চায়, আমি তখন ‘ও আচ্ছা’ বলে অধিক মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে থাকলাম। রুপা বলল
-আমি কিন্তু সিরিয়াস।
-কেন আমার সাথে থাকতে তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?
রুপা আমার হালকা রসিকতার ধার ধারলো না। বললো
-ভালো একজন ডাক্তার খুঁজে বের করো। গুগলে ভালো করে রিভিও পড়ে নিও।
-কি হয়েছে, আমাকে বলো।
-তোমাকে বলা যাবে না।
রুপার উদাস মুখ ও কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে আমার আর রসিকতা করার সাহস হলো না। এবার সত্যি সত্যি একজন ভালো সাইকিয়ারটিস্ট খুঁজে বের করে এপয়নমেন্ট নিলাম।

সাইকিয়ারটিস্ট এর নাম উইলিয়াম ফার। আমরা বসে আছি তার চেম্বারে। একজন নার্স এসে প্রি-হিস্টোরি রিপোর্ট নিয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর সেই রিপোর্ট নিয়ে রুমে ঢুকলেন ডক্টর ফার। নাম শুনে আমার ধারনা হয়েছিলো উনি হয়তো খনখনে বুড়ো, আত্মভোলা প্রফেসারদের মতো হবেন। কিন্তু উনি মোটেই সেরকম নন। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে হবে, কিন্তু দারুন হ্যান্ডসাম। মুখে ট্রিম করা দাড়ি এবং সেটাতে তাকে খুব ভালো মানিয়ে গেছে। রুমে ঢুকে আমাদের দুজনের সাথে হ্যান্ড শেক করলেন
-হাই, আই’ম ডক্টর ফার।
-নাইস টু মিট ইউ।
আমাদের দুজনের দিকে একবার করে চোখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন
-হু ইজ মাই পেশেন্ট?

আমি রুপাকে দেখিয়ে বললাম
-দ্যাটস হার।
-আই’ম সো লাকী টু হ্যাভ দিস বিউটিফুল ইয়ং লেডী এজ মাই পেশেন্ট।
বলে নিজেই নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হাসলেন। রুপার দিকে তাকিয়ে বললেন
-রুপা চাউডুরী, ডিড আই সে ইট রাইট।

আমি জানি এরা কখনই আমাদের মত করে রুপা চৌধুরী বলতে পারবে না, তাই বললাম
-ইয়েস, ইউ ডিড।

ডক্টর ফার খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলেন
-সো রুপা, হোয়াট ব্রিংস ইউ হিয়ার?

রুপা একটু সময় নিয়ে শুরু করলো

-আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। প্রায় প্রতিদিন।
-আচ্ছা।
-ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমি প্রতিবার একই দুঃস্বপ্ন দেখি।
-হুমম, আমাদের অনেকেরই এরকম এরকম হয়। আমি প্রায়ই একটা দুঃস্বপ্ন দেখি, ম্যাথ পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, গিয়ে দেখি কোন প্রশ্নই পারি না। চেষ্টা করেই যাচ্ছি। উত্তর মিলছে না। শেষে যখন মিলতে শুরু করলো, তখন আবার টাইম শেষ। হা হা হা।

রুপা ঠিক হাসলো না, সৌজন্য করে হাসির মতো করলো।

-ডক্টর, আমার দুঃস্বপ্নটা তোমারটার মতো মজার না। আমি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি আমি শুয়ে আছি, আমার বেড রুমের স্লাইডিং ডোরের পর্দা সরিয়ে একটা লম্বা কালো লোক তার লোমশ হাত আমার দিকে বাড়িয়ে আমাকে ধরতে চাইছে। আমি পালাতে চাই, কিন্তু পারি না।
-হুমম, হতে পারে তুমি অতীতে কোন একটা ভয় পেয়েছিলে, তুমি সচেতন মনে সেই স্মৃতিটা ভুলে থাকতে চাও। তোমার অবচেতন মন সেই ভয়টা থেকে মুক্তি পেতে কাজ করে যাচ্ছে। সেটাই বারবার স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসছে। আমাদের মেডিকেল টার্মে এটাকে বলে পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, সংক্ষেপে পিটিএসডি।
-ডক্টর, দুঃস্বপ্নটা এখানেই শেষ হলে আমি তোমার কাছে আসতাম না। সেই লোমশ হাতটা এখন পাশে শুয়ে থাকা আমার মেয়ের দিকে এগিয়ে আসছে।
বলতে গিতে রুপা কেমন কেঁপে উঠে। ওর মুখে আমি এক ধরনের আতংক দেখতে পাই।
-তোমার মেয়ের বয়স কত?
-দশ।
-ডক্টর এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাদের মুখোমুখি দাড়িয়ে একটু ঝুকে বললেন
-তোমার যখন বয়স ৯/১০ ছিলো, তখন কি তুমি কারো দ্বারা সেক্সুয়ালি হ্যারাজড হয়েছিলে?
-না।
‘না’ টা রুপা এত জোরে বললো যে আমরা দুজনেই চমকে রুপার দিকে তাকালাম। ডক্টর ফার আমার দিকে ফিরে বললেন
-আমি কি তোমার স্ত্রী’র সাথে একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে পারি?

আমি ‘শিওর’ বলে উঠে দাড়াতেই রুপা হাতের ইশারায় আমাকে থেকে যেতে বললো।
-হ্যা ছিলো। আমার তখন বয়স নয়, খুব দস্যি মেয়ে ছিলাম ছোটবেলায়। একজন বড় মানুষ আমাকে সাঁতার শেখানোর নাম করে…

রুপা থামলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি রুপার দিকে। রুপা আমাকে কখনো এসব কথা বলেনি। রুপা আবার শুরু করলো
– আমি খুব ভয় পেতাম, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতাম না।

ডক্টর ফার খুব কনফিডেন্টের সাথে জিজ্ঞেস করলেন
-সেই মানুষটা তোমার ক্লোজ রিলেটিভ কেউ ছিলো?

আমি রুপার হয়ে উত্তর দিলাম
-নাহ, নিশ্চয়ই দূরের কোন আত্মীয় হবে।

ডক্টর ফার আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে রুপার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রুপা মাথা নীচু করেই রাখলো, মুখ তুললো না।

আমি রুপার দিকে তাকাতে পারলাম না। সে কি শুধু পুরুষ হিসাবে আমার লজ্জা নাকি আমারো কিছু মনে পড়ে গেলো, সে কথা কেউ জানলো না…

অচিনপুর/ শারমীন সুলতানা ববি

Post navigation