গল্প: জীবন

ফাতেমা তুজ জোহরা
লেকচারার
মেডিকেল কলেজ
কুষ্টিয়া।

গল্প:

জীবন

আজ মজিদ মিয়ার দিন শুরু হইছে খারাপ দিয়া; রাগ করে বাড়ি থেকে চটের ব্যাগে নিজের একখান ময়লা লুঙ্গি, ছেড়া গামছা, টিনের গেলাস,এলুমিনিয়াম এর থালি ভরে বের হয়ে গেছে। আর এক জোড়া মাছ ধরার ছিপ।
মাইয়াডার জন্য পরাণ কানছিল,তাও বের হয়েছে। আর এই সংসারে না।
বিলের শেষে চেয়ারম্যান এর বাড়ি পার হয়ে বাঁশবনের নিচে আয়েশ করে বসে মজিদ।
নাহ,রাগ করে না খেয়ে আসা উচিত কাজ হয়নি। এখন পেটে খিদার হাউস,সকালে বউ ভাত চাপাইছিল চুলায়। আহ, ভাতের ঘিরান!
মজিদ খিদায় বিরক্ত হয়ে ছিপ নিয়ে মাছ ধরায় মন দিবে।
ঝুপ করে কিসের যেন শব্দ। মজিদ ঘাড় ঘুরায়ে দেখে পুকুরে খাবি খাচ্ছে কার যেন ছেলে।
বাচ্চাকাচ্চা মজিদের বড় দূর্বলতা। মজিদ ছিপ ফেলে ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়ে, আহা, কার পোলা পানিত গেলো।
পোলারে পানি থেকে তুলে পাড়ে রাখে, এইবেলা দেখে:চেয়ারম্যানের বংশেরবাতি, আদরের মানিক।
পোলা শীতল পানিতে কাঁপতেছে, মজিদ তার ময়লা লুঙ্গি দিয়ে পোলারে জড়াইয়া নিয়া হাটা দেয় চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে।
চেয়ারম্যান শওকত মোল্লা ছেলের খোঁজে দিশেহারা, লোক লষ্কর পাঠাইতেছে, মজিদ যখন কাছে পোলা নিয়া গেল,চেয়ারম্যানের চেলা চামুণ্ডা কজন এই মারে কি সেই মারে।
“আব্বা, মজিদ পাগলা আইজ আমারে বাঁচাইছে।”
ছয়/ সাত বছরের চেয়ারম্যানের পোলার এই কথায় সেযাত্রা মজিদ বাইচা গেল।
চেয়ারম্যানের বাড়ি তখন শ’খানেক মানুষের ভিড়।
কোথা থেকে ছুটে এসে চেয়ারম্যানের ইস্তিরি পোলারে মজিদের কাছ থেকে নিজের কোলে নিয়ে সরু গলায় কানতে লাগলো।
মজিদের মন উদাস হয়ে গেলো।
আহা! এই পোলা আইজ আমার নিজের হইতে পারতো, চেয়ারম্যানের ইস্তিরি না হইয়া আমার বউ হলে কী দোষ হইত!
“মজিদ, কাপড় বদলাইয়া বস,কথা আছে।”চেয়ারম্যান আইজ মজিদরে তুমি কইরা বলতাছে। মজিদ আবারো উদাস হইয়া যায়। আইজ দিন সুবিধার না। সে কাপড় বদলাইয়া নেয়, তারে বসার খেজুর পাটি দেয়া হয়;মজিদ আরাম কইরা বসে।
ভেতরবাড়ি থেকে খানা খাদ্য আসে: গরম ধোয়া উঠা ভাত,বিলের নতুন পানির মাছের সালুন আলু দিয়া, বড় এক বাটি গরুর দুধ।
হাত ধুইয়া বিসমিল্লা বইলা মজিদ ভাতের গামলায় মাছের সালুন ডালে, ঝোলে ভাত মাখাইয়া খুব যত্নে এক লোকমা ভাত মুখে দেয়। কি জানি মজিদের দু’চোখ গড়িয়ে জল নামে, গাল বেয়ে দু’এক ফোটা ভাতের সাথে মিশে যায়, মজিদের বুঝে আসে না কেন সে কান্দে। সকালে বউ আর মায়ের অপমান না মাইয়াডার জন্য না চেয়ারম্যানের ইস্তিরি, যারে সে শিউলিমালা বইলা ডাকতো তার জন্য না তার এই ছন্নছাড়া জীবনের জন্য মজিদ জানে না। ভাতের লোকমা মুখে দেয় ঝাপসা চোখে,সে মুছবার চেষ্টা করে না। সব ভেসে যাক মুছে যাক নোনা জলে…

মজিদ আরাম কইরা ভাত খায়,ঝাঁপসা চোখে মাছের কাঁটা বাছে। দুধের বাটি দুই হাতে নিয়া চুমুক দেয়। তৃপ্তি নিয়া খাওয়া শেষ করে।
চেয়ারম্যানের চেলারা দূরে দাঁড়ায় দেখতাছে মজিদের আরামের খাওয়া।
হাত ধুইতে ভিতর বাড়ির চাপকলে যায় সে, হাত মুখ ধুইয়া কুলকুচো করার পানি ফিচিক কইরা ফেলানোর সময় মাটির দিকে নজর, দুইটা ফরসা পা -নীল তাতের শাড়ির পাড়, সবুজ স্পঞ্জ স্যান্ডেল পরা, মজিদ নজর উপরে তুলতে ভুলে যায়!
“আপ্নের পান নেন।”
মজিদ নজর নিচু রাইখায় হাত বাড়িয়ে পান নেয়।
কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ খেলা করে, বিলের দিক থেকে হুহু করে শীতল হাওয়া গায়ে কাঁপন ধরায়, মজিদ ফিরে এসে পান হাতে নিয়ে আবার পাটিতে বসে।মনের চোখে দেখে এক জোড়া ফরসা পা!
চেয়ারম্যান এর সকালের খানা খাদ্যের বেবস্থা হয়তেছে,ব্যস্ত ভাব।
সামনে টেবিলে সাজানো হইতেছে,মজিদ আগ্রহ ভইরা দেখে,দুনিয়াতে এই একটা কাজেই মজিদের বড়ই আগ্রহ, ভালো লাগে তার খানা খাওয়া দেখা, কেউ আরাম কইরা খায় দেখতেও আরাম।
চেয়ারম্যানের মুখে আরামের ভাব নাই, মজিদ খেয়াল করে,খানা খাওনের সময় মুখে তিতা খাওয়া ভাব। সেইটাও মজিদ দেখে।
“শওকত, তুমার পুলারে সাঁতার শেখনের বেবস্থা কর।”
চেয়ারম্যান বেদম বিষম খায়! শওকত নামে তারে এখন কম ডাকে, সে চেয়ারম্যান সাব এখন,মজিদ এই বিষম দেইখা মজা পায়।
“বুঝলা শওকত, গেরামের পুলা, তাও চেয়ারম্যানের, তার সাঁতার শেখন জরুরী, আমার পুলা তারে সাতার শিখাইব, আমি বইলা দিবো।” কথাগুলো বইলা মজিদের আরাম লাগে। সে চুপ কইরা যায়।
চেয়ারম্যান খানা শেষ কইরা পান নিয়া মুখে দেয়,
“মজিদ তুমি ঠিক কইছ, পুলার সাঁতার শেখন জরুরী, আদরের পুলারে তার মায়ে কিচ্ছু করতে দেয়না। তুমি পুলারে পাঠাই দিও। আর তুমার পুলা করে কি?”
“সে ইস্কুল পাশ দিবো। খুব পড়ার শখ।”
“মজিদ, তুমি কি চাও, আইজ আমার বংশের বাতি তুমি আবারো জ্বালাইছ। যা চাও তাই দিবো। ”
“আল্লাপাক তুমারে অনেক দিছে,ক্ষমতা, টেকা: সব, আমি যা চাই তুমি কি সত্যই পারবা!”
চেয়ারম্যান চমকে তাকায়।
“না ভয় নাই, আমার কিছু লাগবো না, তুমি আমার পুলা আর মাইয়াডার পড়ার খরচ দিও, তাদের খুব পড়নের শখ।”
আর বিলের ধারে একটা উঁচু মাচানে টংঘর বানাইয়া দাও,আমি মাছ ধরব আর এইখানেই থাকুম।আর দরকার লাগলে আমি নিজে চাইয়া নিমু।”
চেয়ারম্যান এর হুকুমে মাচান আর টংঘর বানানো চলতাছে। মজিদ দেখে। হাতে পান নিয়া ভাবে, হায়রে মাইনষের জীবন!
সে তার পুরানো দিনের কথা ভাবে…

পড়ালেখায় মজিদ ভালোই ছিল,বাপজানের শখ ছিল, মজিদ পাশ দিয়া গেরামে ইশকুল দিব। গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার কদিন আগে মজিদের বাপজান শহর থেকে রাতে বাড়ি ফেরার পথে খুন হয়, সাথের সব টাকাকড়িও গায়েব, বড় দোকান ঘর পরেরদিন গিয়ে দেখে পুইড়া ছাই কয়লা হইয়া আছে, ফসলি জমির ক্ষেত কেটে নিয়ে গেছে সব!
মাত্র কদিনের মইধ্যে অবস্থাপন্ন থেকে মজিদেরা হয়ে পড়ে এমন অবস্থাহীন।
ছোট দুই বোন আর মজিদকে নিয়ে বিধবা মার পথে বসা অবস্থা।
মজিদের পরীক্ষা শেষ হয়,কিন্তু জীবনের পরীক্ষা তখন সবে শুরু!

কয়েক পলকে যেন মজিদ নিজের জীবনের চলচ্চিত্র দেখে নেয়।
#জীবন৩
শুরু হয় মজিদের জীবন যুদ্ধের পরীক্ষা, যার বিচারক উপর আলা!
আমজাদ চাচার মেজ মেয়ে শিউলি, মায়ায় ভরা যেন দুচোখ। মজিদের ভালো লাগতো শিউলিকে, আর এটাও বুঝতো,শিউলিরও তাতে সায় আছে।
মজিদ মাকে বলে রাজিও করিয়েছিল, কথা প্রায় পাকাপোক্ত, শহরের স্কুলে মজিদের শিক্ষকতা শুরু হবে,শুভ দিন দেখে শিউলিকে ঘরে আনবে।
মজিদ শিউলিমালা বলে ডাকতো, হাটে গিয়ে লাল পেড়ে তাঁতের শাড়ি আর ক’গাছি কাচের চুড়ি কিনে এনেছিল, মা,বোনেরা দেখে যদি শরম দেয় তাই লুকিয়ে রেখেছিল।
তারপর?
তারপর চেয়ারম্যান লিয়াকত মোল্লার কালো আর লম্বা হাতের বিষের ছোবলে মজিদের বাবার দোকানঘর হলো ছাই, ব্যবসার টাকা কড়ি নিয়ে মজিদের বাবার লাশ রাতের আঁধারে রক্তাক্ত হয়ে থাকলো ; স্কুলে চেয়ারম্যানের পেয়ারা মানুষ নেয়া হলো,আর-গা ভরা সোনার গয়না পরে মজিদের শিউলিমালা চেয়ারম্যান এর পুলা শওকতের ঘরনি হয়ে এক বিকেলে কনে দেখা আলোয় অন্যের হয়ে গেল!
মজিদের কেনা লাল পেড়ে শাড়ি আর চুড়ি তার বুকে রক্ত ঝরালো। সবার চোখের আড়ালে বিলের নতুন ফুলে ফেঁপে উঠা জলে মজিদ বিসর্জন দিলো, সেই সাথে মজিদের বোধ-বুদ্ধিও যেন বিলের জলে ভেসে গেলো।
মজিদ বাড়ি এসে কাউকে চিনেনা, সব অচেনা মুখের ভিড়,মজিদের মাথার মাঝে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় থেকে থেকে।
গেরামের সবাই এখন মজিদরে বলে মজিদ পাগলা, বি এস সি!
মজিদ নিজেও মজা পায়, পাগলা আবার বি এস সি পাশ।এই মজিদ ভালো , তো আবার ক্ষেপামি করে।মজিদের কিসসু ভালো লাগেনা, সে বিলের ধারে বসে থাকে, দিনের শেষে তারে ধরে নিয়ে আসে মা বোনেরা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে,মজিদ সেই সময়ের চিন্তা ছেড়ে ফিরে আসে আবার চেয়ারম্যানের ভিটের কাঁঠালতলায়, রোদ মরে এসেছে ততক্ষনে।
চেয়ারম্যান ভিতরবাড়ি থেকে এসে মজিদের সামনে তার চেয়ারে বসে।
“শওকত, আমি মজিদ পাগলা হলেও বি এস সি পাশ, বইসা থাকি, আমারে একটা ইশকুল বসায়া দেও গেরামে, আমি পড়াই পুলা মাইয়ারে, গেরামের উন্নতি হোক; তুমার পুলারেও তো পড়াইতে হইব, চেয়ারম্যান এর পুলা অশিক্ষিত হইতে পারে না, কি কউ।”
চেয়ারম্যান ঝিম ধরে থাকে,আইজ তার অন্য রকম লাগে,নিজে বেশি বিদ্যাধর না হলেও বাপের সুতায় আইজ চেয়ারম্যান, শওকত নিজেও জানে কিছু কিছু, তার বাপের সব কিছুই কালো হাতের আদায় করা সহায় সম্পদ। যার সাক্ষী মজিদ, যারে গেরামে সবাই পাগলা বইলা ডাকলেও মজিদ বি এস সি: আর সে নিজে চেয়ারম্যান হইয়াও শিক্ষা নাই বললেই চলে। আইজ যদি মজিদের কথায় ইশকুল করা হয় কিছু হলেও তার বংশের পাপ মোচন হবে।

“মজিদ মিয়া,কথা ঠিকি কইছ,আমার গেরামে ইশকুল হইব,তুমি তার মাথা হইবা। আমার পুলা বড় হইতেছে, তার ও পড়ন লাগবো। ”
“শওকত, তুমি মানুষ ভালাই আছো। পুলারে দেইখা রাইখো।”
মজিদ তার চটের ব্যাগ নিয়া বিলের ধারে দাঁড়ায়, চেয়ারম্যানের চেলারা মাচান বানাইতেছে, মজিদ চোখ ভইরা দেখে।
“বাপজান, বাড়িত চলো, মা আর দাদী কান্তাছে।”
মজিদের মাইয়া মুন্নি কখন আইসা দাঁড়াই আছে,মজিদ মাইয়ারে কাছে নিয়া বলে,”আম্মাজান, আমি যুদি আর না ফিইরা যাই, তুমার কষ্ট হইব?”
“কি যে কউ না বাপজান, কেন ফিরবা না, আমি, ভাই, মা,দাদি তুমারে কত ভালোবাসি,আর তুমি না থাকলে আমার আর ভাইয়ের পড়া হইব কেম্নে!”

“হ,আম্মাজান। আইচ্ছা চল যাই,বাড়িত যাই।”
মজিদ ফেরার আগে বিলের ঢেউ খেলা পানিতে তাকাইয়া দেখে,লাল শাড়ি যেখানে টুপ করে তলাইয়া গিয়েছিল, আজ আবার সেখানে দ্বিতীয় বারের মত সেই লাল রক্ত ঝরা স্মৃতি ফেলে আসে;
সামনে তার নতুন দিন, নতুন জীবন, বেঁচে থাকার নতুন পাল ধরবে: মুন্নি, পুলা, বউ, মা আর ইশকুল নিয়ে।
মজিদ ভাবে,এর নাম তাইলে জীবন। চেয়ারম্যান এর পুলা জলে ডুবতে ডুবতে যেন তাকে ভাসিয়ে আর বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
আজ আর মজিদের খেদ নেই জীবনে, মজিদ তার বাকি জীবন এক পলকও নষ্ট করতে চায় না।
ভরা বাদলের নতুন পানির বিলের মত মজিদের নতুন জীবন!

Post navigation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *