জাপান কাহিনিঃ সামাজিক শিক্ষা

আশির আহমেদ
কিউশু, জাপান।

নন ফিকশন: জাপান কাহিনিঃ সামাজিক শিক্ষা

জাপানে পড়তে আসা এক বাংলাদেশী ছোট ভাই একদিন ফোনে বললো
-আশির ভাই, বড়ই লজ্জায় আছি।
-কেন কি হয়েছে?
-ড্রইং ক্লাসে ড্রইংবক্স নিয়ে যাইনি।
-তো?
-জাপানি স্যার বড় একটা শিক্ষা দিয়েছেন।
-কি করেছেন?
-আমার কাছে এসে উল্টা ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন আজ যে ড্রইং বক্স নিয়ে আসতে হবে তা স্মরণ রাখার মত জোর দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন নি। তাই তিনি দুঃখিত।
-হুম।
আমি তো আর কোনদিন ড্রইংবক্স নিতে ভুলব না, আশির ভাই। আজ যদি তিনি আমাকে বকা দিতেন বা অন্য কোন শাস্তি দিতেন, আমি কোন একটা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম।

২০১১ সালের ১১ই মার্চ। Tsunami র আগাম বার্তা শুনে এক ফিশারি কোম্পানীর মালিক সাতো সান প্রথমেই বাঁচাতে গেলেন তার কর্মচারীদের। হাতে সময় আছে মাত্র ৩০ মিনিট। প্রায়োরিটি দিলেন বিদেশিদের। একে একে সব কর্মচারীদের অফিস থেকে বের করে পাশের উঁচু টিলায় নিজ হাতে রেখে এলেন। সর্বশেষে গেলেন তার পরিবারের খোঁজ নিতে। ইতিমধ্যে Tsunami সাহেব এসে উপস্থিত। সাতো সানকে সবার চোখের সামনে কোলে তুলে গোগ্রাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। আজও নিখোঁজ হয়ে আছেন তার পরিবার। ইসস্ সাতো সান যদি রানা প্লাজার মালিকের সাথে একটা বার দেখা করার সুযোগ পেতেন!

এই কাহিনি আমি যত জাপানিদের বলেছি, কেউ আশ্চর্য হননি, উল্টো বলেছেন, “এটাই তো স্বাভাবিক, তুমি হলে কি তাই করতে না?”

না মনে হয়। প্রতি বছরই আমাদের দেশে লঞ্চ-ডুবি হয়। এরকম কাহিনি ঘটে থাকলে নিউজে আসত। বাল্যকাল থেকে আমরা “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” শিখেছি। টাইটানিক ছবিতে জাহাজের ক্যাপ্টেইন স্মিথ সাহেবকে আজও বীর হিসাবে দেখানো হয়।

জাপানে এই ঘটনা এতই স্বাভাবিক যে সাতো সান স্থানীয় পত্রিকায়ও স্থান পেলেন না। বীরের স্থান নিয়ে অমর হলেন চায়নাতে। চাইনিজরা দেশে ফিরে গিয়ে শহরের চৌরাস্তায় ওনার প্রতিকৃতি বানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

আরেক কাহিনি বলছি। এটা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া। নয় বছরের এক ছেলে। স্কুলে ক্লাস করছিল। Tsunami-র আগমনের বার্তা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ সব ছাত্রদের তিন তলায় জড়ো করলেন। তিন তলার বেলকনি থেকে সে দেখলো তার বাবা আসছে গাড়ি নিয়ে। গাড়িকে ধাওয়া করে আসছে ফোঁসফোঁসে পানির সৈন্য দল। গাড়ির স্পিড পানির স্পিডের কাছে হার মেনে গেলো। চোখের সামনে ভাসতে ভাসতে নাই হয়ে গেল বাবা। সৈকতের নিকটেই ছিল তাদের বাসা। মা আর ছোট ভাই ভেসে গেছে আরো আগে।
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ছেলেটি আশ্রয় শিবিরে উঠলো। শিবিরের সবাই ক্ষুধায় আর শীতে কাঁপছে। ভলান্টিয়াররা রুটি বিলি করছেন। আশ্রিতরা লাইনে দাড়িয়ে আছেন। ছেলেটিও আছে। এক বিদেশী সাংবাদিক দেখলেন, যতটুকু খাদ্য (রুটি) আছে তাতে লাইনের সবার হবে না । ছেলেটির কপালে জুটবে না। সাংবাদিক সাহেব তার কোটের পকেটে রাখা নিজের ভাগের রুটি দুটো ছেলেটিকে দিলেন। ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে রুটি গ্রহন করলো। তারপর যেখান থেকে রুটি বিলি হচ্ছিল সেখানেই ফেরত দিয়ে আবার লাইনে এসে দাঁড়াল। সাংবাদিক সাহেব কৌতুহল ঢাকতে পারলেন না। ছেলেটিকে জিজ্ঞাস করলেন-এ কাজ কেন করলে খোকা? খোকা উত্তর দিল-বন্টন তো ওখান থেকে হচ্ছে। ওনাদের হাতে থাকলে বন্টনে সমতা আসবে। তাছাড়া লাইনে আমার চেয়েও বেশী ক্ষুধার্ত লোক থাকতে পারে।

বলে কি? আমি কি কোন নবীজির বাল্যকাহিনি পড়ছি?

সহানুভুতিশীল হতে গিয়ে বন্টনে অসমতা এনেছেন-এই ভেবে সাংবাদিক সাহেবের পাপবোধ হলো। এই ছেলের কাছে কি বলে ক্ষমা চাইবেন ভাষা হারালেন।

যারা জাপানে থাকেন, এ ধরনের ঘটনা অহরহ দেখে হয়তো অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। আপনি ট্রেনে বাসে কোন জিনিস হারিয়েছেন, অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, ঐ জিনিস আপনি অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাবেন। গভীর রাতে কোন ট্রাফিক নেই, কিন্তু পথচারী ঠিকই ট্রাফিক বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত পথ পার হচ্ছেন না। ট্রেনে বাসে টিকিট ফাঁকি দেয়ার রেট প্রায় শুন্যের কোঠায়। আমি একবার ভুলে ঘরের দরজা লক না করে দেশে গেলাম। মাস খানেক পর এসে দেখি, যেই ঘর রেখে গেছি, সেই ঘরই আছে।

এই শিক্ষা জাপানিরা কোথায় পায়? লিখতে গেলে একটা পি,এইচ, ডি থিসিস হবে। একটু আভাস দিচ্ছি।

সামাজিক শিক্ষা শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকে। সর্বপ্রথম যে তিনটি শব্দ এদের শিখানো হয় তা হলো-

(১) কননিচিওয়া (হ্যালো)-
পরিচিত মানুষকে দেখা মাত্র “হ্যালো” বলবে।

(২) আরিগাতোউ (ধন্যবাদ)- সমাজে বাস করতে হলে একে অপরকে উপকার করবে। তুমি যদি বিন্দুমাত্র কারো দ্বারা উপকৃত হও তাহলে “ধন্যবাদ” দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

(৩) গোমেননাসাই (দুঃখিত)-
মানুষ মাত্রই ভুল করে। তুমিও করবে। নিজ দায়িত্বে ভুলকে আইডিন্টিফাই করবে এবং সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে।
এগুলো যে শুধু মুখস্ত করে শিখানো হয় তা না। বাস্তবে শিক্ষকরা প্রো-এক্টিভলি সুযোগ পেলেই ব্যবহার করবেন এবং করিয়ে ছাড়বেন।

সমাজে এই তিনটি শব্দের গুরুত্ব কত তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। এই শিক্ষাটা এবং প্র্যাকটিস বাল্যকাল থেকে করতে শিখে। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাল্যকালটা যদি কোন রকমে জাপানের কিন্ডারগার্টেনে কাটিয়ে আসতে পারতেন।

কিন্ডারগার্টেন থেকেই স্বনির্ভরতার ট্রেনিং দেয়া হয়। সমাজে মানুষ হিসাবে বসবাস করার জন্য যা দরকার-নিজের বই-খাতা, খেলনা, বিছানা নিজে গোছানো; টয়লেট ব্যবহার, পরিষ্কার করা; নিজের খাবার নিজে খাওয়া, প্লেট গোছানো ইত্যাদি সব ছাত্রকে হাতেনাতে শিখিয়ে দেবেন। প্রাইমারী স্কুল থেকে নিজেরা দল বেঁধে স্কুলে যায়। দল ঠিক করে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ট্রাফিক আইন, বাস-ট্রেনে চড়ার নিয়ম কানুন সবই শেখানো হয়। আপনার গাড়ি আছে, বড়াই করে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসবেন, উল্টা আপনাকেই লজ্জা পেয়ে আসতে হবে।

ক্লাস সেভেন থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে পারবে। ক্লাসে কে ধনী, কে গরীব, কে প্রথম কে দ্বিতীয় এসব বৈষম্য যেন তৈরী না হয় তার জন্য যথেষ্ট সতর্ক থাকেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ক্লাসে রোল নং ১, মানে এই নয় যে একাডেমিক পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল। রোল নং তৈরী হয় নামের বানানের ক্রমানুসারে।

বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সমস্ত আইটেমগুলো থাকে গ্রুপ পারফরম্যান্স দেখার জন্য – ইন্ডিভিজুয়েল নয়। সারা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের ভাগ করা হয় কয়েকটা টা গ্রুপে-সাদা দল, লাল দল, সবুজ দল ইত্যাদি। গ্রুপে কাজ করার ট্রেনিংটা পেয়ে যায় খেলাধুলা জাতীয় এক্টিভিটি থেকে। এই জন্যই হয়তো জাপানে বড় লিডার তৈরি হয় না কিন্তু গড়ে এরা সবার সেরা।

অচিনপুর ডেস্ক / এসএস ববি

Post navigation