জাপান কাহিনিঃ জাপানে বৃদ্ধ লোকদের কান্ডকারখানা

আশির আহমেদ
কিউশুয়ু, জাপান।

নন-ফিকশন: জাপান কাহিনিঃ জাপানে বৃদ্ধ লোকদের কাণ্ডকারখানা

আমার সেই জাপানি মা গল্প বলা শুরু করলেন। অসহায় বৃদ্ধদের গল্প।
রাত তিনটার সময় ওনাদের কলিং বেল বেজে উঠলো।
এতো রাতে কেউ দরজা খোলে?
দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখলেন। পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতি দাঁড়িয়ে আছেন। আশি বছরের উর্ধ্বে তাঁদের বয়স।

-কি খবর? কি হয়েছে?
-ভূত, আমাদের বাসায় ভূত এসেছে।
ভদ্রমহিলা কথা বলছেন, স্বামী ভদ্রলোক শুধু সায় দিয়ে যাচ্ছেন।
-বলেন কি? কই দেখি?
-এই যে এই বিছানার ওপরেই বসা ছিল। এখন দেখতে পাচ্ছি না।
-বুঝলাম। এখন ঘুমান। ভূত সম্ভবত চলে গেছে।
-নাহ যায়নি। তোমরা থাকো না আমাদের বাসায় আজ রাতে। সকালে চলে যেও।

মা-জান বললেন
– একবার নয়, দুইবার নয়, কয়েক ডজন বার ওনাদের বাসায় ভূূত দেখতে গিয়েছি। বুড়োবুড়ি ঘুমানোর পর নিজ বাসায় ফিরতে হয়েছে।

তারপর?
-আর কি? একদিন বৃদ্ধ মারা গেলেন। ফ্ল্যাট বিক্রি করে বৃদ্ধা এক বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।

এরকম বৃদ্ধদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হয়ত কয়েকদিন পর নতুন ব্যবসা শুরু হবে।
বাসায় একা? ভূতের ভয় পাচ্ছেন?
এক্ষুনি কল করুন ৯৯৯৯ নম্বরে।
আমাদের “সঙ্গী পাঠাও” সার্ভিসে। মহিলা সঙ্গীর জন্য ১ চাপুন। ৪০ উর্ধ্ব সঙ্গীর জন্য ২ চাপুন।

শুধুই কি বৃদ্ধরা ভুত দেখে?

গত সোমবার রাত ৯ টায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরছি। গাড়ি পার্কিং একটু দূরে। ৫ মিনিট হাঁটার পথ। মাঝখানে ২ মিনিট অন্ধকার। একটু জঙ্গলও আছে। আমি হাঁটছি। হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মানুষ পড়ে যাবার শব্দ। আমি পেছনে তাকালাম। কিছুই দেখলাম না। সামনে হাঁটার সাহস পেলাম না। আমার সারা গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মুরগির চামড়ার মত অবস্থা। দিলাম দৌড়। ইউটার্ন। গাড়ি ক্যাম্পাসে রেখে বাসে ফিরলাম।

আপনি বলবেন, ওটা মনের ভূত।
বুঝলাম। সত্যিকারের ভূত হলে তো ফাইট দিতাম। এই মনের ভূত খেদাই কি করে?
রাতের বেলা স্বপ্ন দেখলাম। এক বিশাল দৈত্য আমাকে মারতে আসছে। আমার সারা শরীর অবশ। আমি দৌড়াতে পারছি না। স্বপ্নের মধ্যেই সূরা এখলাস পড়ছি। দৈত্য যাচ্ছে না। এই রোগকে আমাদের গ্রামে বলে “বোবায় ধরা রোগ”। এই রোগ আমার আগেও ছিল। শুরুটা হয়েছিল একটা ভূত দেখে।
তখন আমরা এখলাসপুরে থাকি। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি।
চাঁদনি রাত। গ্রীষ্মকাল। আমাদের নতুন ঘর উঠছে। ওপরের চাল (ছাদ) দেয়া হয়েছে। চারিদিক খোলা। কোন বেড়া দেয়া হয়নি। চাঁদনি রাতে গানবাজনা শুরু হলো। গান শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি – গানবাজনা শেষ। একটা পাটির ওপর আমরা কয়েকজন শুয়ে আছি।
আমার টয়লেট পেল। ছোটটা। পাশে আনারস বাগান। বাগানের ওপারে টয়লেট করে ফিরছি। দেখি, ঠিক আমার কাঁধ উচ্চতার কেউ একজন আমাকে ফলো করছে। প্রথম ভাবলাম আমার ছায়া।
জ্বি-না। আমার ছায়া না। সম্পুর্ন কালো লোমওয়ালা এক বস্তু দেখলাম।
আমি হাঁটলে সে হাঁটে। আমি থামলে সে থামে।
নেক্সট আইটেম চেক করলাম। তাঁর পা। পা যুগল মাটিতে লাগানো নেই। সে ভাসছে।
আমি এক দৌড়ে পাটিতে ফিরলাম। তার কয়েকদিন পর থেকে আমার “বোবায় ধরা” শুরু হলো।
—-
জাপানে যে সব জায়গায় ভূত আসে তা মোটামুটি নির্দিস্ট করা। যারা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন তাঁরা দেখতে পাবেন টয়লেটের বেসিনের আয়নায়। এই তথ্য জানার পর আমি টয়লেটের আয়না দেখলেই মনে মনে একটা গান গাই।

আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন
কপালের কালো চুল পড়বে চোখে
আলতো করে হাত রাখবে কাঁধে
ভূত যে এসেছিলো জানবে লোকে।

বৃদ্ধদের কত সমস্যা। বয়স বাড়তে থাকলে বৃদ্ধরা নাকি বাচ্চাদের মত আচরণ করে।
খাইয়ে দিতে হয়, ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়। এটা খাব না, ওটা খাব না আহ্লাদ করতে থাকেন। শিশুরা যুক্তি দেয় না। কিন্তু বৃদ্ধরা যুক্তি দেয়। শিক্ষিত অভিজ্ঞ শিশু বলতে পারেন।
(১) এক বৃদ্ধ সব সময় দাঁড়িয়ে থাকেন। ওনার যুক্তি হলো পৃথিবীর ৯৭ ভাগ মানুষ শোয়া অবস্থায় মারা যান। উনি বেশিদিন বাঁচতে চান। তাই নিজেকে শোয়া অবস্থায় দেখতে চান না। শুয়ে ঘুমান না। দাঁড়িয়ে ঘুমান। এটাকে ঘোড়া রোগ ভাবার কোন উপায় নেই।

(২) জাপানে একটা টিভি অনুষ্ঠান হয় বৃদ্ধদের নিয়ে। কুইজ প্রোগ্রাম। ছোট ছোট সিম্পল প্রশ্ন করা হয়। কী যে মজার মজার উত্তর দেয়!
একবার জিজ্ঞাস করা হলো- আপনার বউ এর নাম কি?
সাথে সাথে সবাই বেল বাজিয়ে উঠলেন। এমন একটা ভাব যে, প্রশ্ন কমন পড়েছে। আজ সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন।
একজন উত্তর দিল – ওড্রে হেপবার্ন
আরেকজন – ম্যাডোনা
আরেকজন – সোফিয়া লরেন।
উপস্থাপক লইরা বসলেন। মিচকি মিচকি হাসলেন, বললেন – দেখছেন বুড়োদের ভীমরতির অবস্থা।
(৩) এই কাহিনি আগেও বলেছি। জাপানের এক টিভি অনুষ্ঠানের গল্প। উপস্থাপক বিভিন্ন বাড়িতে যান এবং বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করেন।
কত কিসিমের জিনিস বেরিয়ে এলো। এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করা হলো – আপনার বাড়িতে অপ্রয়োজনীয় কিন্তু মূল্যবান কিছু আছে?
জ্বি আছে। উনি ঘরে গেলেন। বের করে নিয়ে এলেন ওনার অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর স্বামীকে। এক সময় মূল্যবান ব্যাক্তিটি ছিলেন। কিন্তু এই বাসি জিনিস বৃদ্ধার এখন আর কাজে আসছে না।
আমিও বৃদ্ধ হবো। আপনিও হবেন। কি কি প্রস্তুতি নিলে মানুষ আমাদেরকে শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ শিশু বলে গালি দেবে না?

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation