শারমিন আঞ্জুম
নিকেতন, ঢাকা।
ধারাবাহিকঃ জলতরঙ্গ(প্রথম পর্ব)
(একটা আধুনিক রূপকথা)
– নিশু বেবি টাকা ম্যানেজ হলো?
– হচ্ছে! নিশা নীচু গলায় জবাব দিল
– না হলে don’t be shy darling, my offer is still open!
– আমার পক্ষে সম্ভব না সায়মন! আগেই বলেছি।
– কাম অন সুইট হার্ট ! তুমি এটাকে স্পোর্টিংলি কেন নিচ্ছ না?
Why are you getting so prude unnecessarily! ধরে নাও তোমার বাড়িতে গেস্ট এসেছে, তুমি তাকে স্কর্ট করে সারা বাড়ি দেখাচ্ছ!এটাও গেস্ট হ্যান্ডেল করার মতই , তাকে নিয়ে পুরা সিলেট ঘুরো, ফাইভস্টার রিসোর্ট, ফুর্তি সব ফ্রি, শুধু তাকে কোম্পানি দাও উইথ সাম মোর কর্ডিলিটি! এখন সে আমার বিদেশী অতিথি ক্লাসি জিনিসে আগ্রহ বুঝলে , আমার সেক্রেটারীটা আবার আরেক জায়গায় লাগিয়েছি নয়তো…
নিশা ফোন কেটে দিল। তার কান ঝা ঝা করছে! ঘেন্না হচ্ছে নিজের উপর । এই সেই সায়মন যে শর্তে হেরে নিজের টি শার্ট খুলে নিশার গাড়ি মুছে দিয়েছিল।
জুয়েলারি শোরুমের কাঁচের দরজার ওপাশে, শাওন হেটে গেলো মনে হলো! পাশের ডায়মন্ডের শোরুমেই ঢুকেছে সাথে বেশ ফর্সা একজন তরুণী! কে হবে? যাই হোক… নিশার কি? তার কাজ দ্রুত হয়ে গেলেই হয়। কিন্তু ম্যানেজার আঙ্কেল এত দেরি করছে কেন?
শাওন দেখে না ফেললেই হয়। নিশার আজকাল সবার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।যেন বিচিত্র এক না করা অপরাধের অপরাধী সে। প্রাণপন চেষ্টায় থাকে পূর্ব পরিচিত কেউ তাকে দেখে না ফেলে! এখন সবাই ভারী বিচিত্র চোখে তাকায় তার দিকে। ফিস ফিস করে বলে কত কিছু, হয়তোবা কিছুই বলে না, হয়তো গুরুত্বই দেয় না। তবু নিশার মনে হয় যেন তাকে নিয়েই বলছে। জানিস নিশার বাবা পুরা দেউলিয়া হয়েই মারা গেছে এরা এখন পথের ভিখারী! কোথায় গুলশান দুই এর আলিশান বাংলো, কই বাড্ডার তিন কামরার ভাড়া বাসা!
– মা! এই ধর, সর্বসাকুল্যে এই ম্যানেজ হলো!
নিশা চমকে উঠলো আবারও ওই আগের চিন্তা! সেই পড়ে যাওয়া অতীত!
-চাচা! মাত্র ত্রিশ হাজার? পুরা দেড় ভরির চেইন এটা, আপনাদের এখান থেকেই নেয়া।
-“রিসেল ভ্যালু কমই হয় মামনী, তার উপর আঠারো ক্যারেট গোল্ড , সেই হিসেবে তো বেশিই দিয়েছি, তোমরা পুরানো লোক।
– আঠারো ক্যারেট? কেনার সময় তো বলেননি চাচা!
ম্যানেজার নেওয়াজ মুখ ভরা হাসি দিলো- বলেছি মামনি, এটা উল্লেখ করে বিলও করেছি! তুমিই খেয়াল করনি!
– আর হীরার এই লকেট? এটার প্রাইস?
-মা এটা তো ক্যারেট ডায়মন্ড না, এর বাংলাদেশে কোন রিসেল ভ্যালু নেই। তবু এর দাম ধরলাম আমি, আরও পাচ হাজার! এর চেয়ে বেশি দিতে পারবো না মা!
নায়লা খালার কথা গুলো মনে পড়ছে, “তোর পাসপোর্ট মেলা ভারি। কয়েকটা দেশের ভিসা লাগানো, আমি ক্যানাডায় ইমিগ্রেশন এর জন্য এপ্লাই করছি তোদের দুজনের জন্য। কয়েকটা দিন শুধু কষ্ট কর। কিন্তু নিশু, যেকরেই হোক গ্রেজুয়েশনটা কমপ্লিট করে আয়!”
নায়লা খালার ভরসায় এত দূর এগিয়েছে নিশা, মায়ের আর নিজের জমানো কিছু টাকা ছিড়ে ছিড়ে চলেছে কিছু দিন, বাসা ভাড়া, বাজার খরচ এসবেই পার হচ্ছিল। কয়েক দিন আগে শুনলো নায়লা খালার নিজের চাকরিই নেই।
নিশা চোখে চারপাশে সর্ষে ফুল দেখছে! তার ফাইনাল সেমিস্টারের ফিস জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট আর দুদিন পর! যে করেই হোক এই কোর্স শেষ করবে। আশি হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে… সব মিলিয়ে মিলিয়ে বিশ জোগাড় হয়েছে….
“don’t be shy darling my offer is still open ”
সায়মনের কথা গুলো কানে বাজছে!
বড় পিপাসা পেয়েছে! ম্যানেজার সাহেবকে বলতে ইচ্ছা করলো আঙ্কেল একগ্লাস পানি খাওয়ান, একসময় এই দোকানে কিছু কিনতে এলে খালি মুখে ফিরতে গেলে আপসোসের সীমা থাকতো না আর এখন ম্যানেজার সাহেবের হাসির মধ্যেই দাক্ষিণ্য ছলকে পড়ছে, সে এখানে আর ক্রেতা নয় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিক্রেতা । এখন ফ্রি ড্রিঙ্কস একটু বেশিই দুরাশা। নিশা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল!
**
টাকা নিয়ে প্রমিনেন্ট জুয়েলারি থেকে বের হতে হতে চোখ পড়লো পাশের দোকানে! শাওন এখনও দাঁড়িয়ে।নিশা ওড়না দিয়ে মাথাটা ডেকে নিল যাবার পথে ।
কি খুশি ছিল শাওন! মুখ ভরা হাসি, হাসিটা বরাবরই অসাধারন শাওনের। তার সাথের মেয়েটির গলায় হীরে আর রুবির একটা নেকলেস! মেয়েটাও হাসছে, এই তাহলে সঞ্জনা! শাওনের ভাবী বধু! মেয়েটার গলায় রুবির নেকলেস, লাল রঙ পছন্দ ছিলো না তো শাওনের। মনে আছে এংগেজমেন্টের দিন সে বলেছিল, বিয়েতে লাল কিন্তু কিচ্ছু না দেখি! লাল থাকবে শুধু তোমার ঠোঁট আর গালে আর কোথাও না !নিশার কি অদ্ভুত শিহরণ লেগে গিয়েছিল শরীরে! শাওনের পছন্দ বদলে গেল কবে? কে জানে সময় আর পরিস্থিতি মানুষের প্রবৃত্তি পছন্দকেও বদলে দেয় হয়তো।
কবে থেকে বদলে যাচ্ছিল শাওন? বাবাকে খাটিয়ায় করে যখন কবরস্থানে নিচ্ছিল ওরা, নিশা কি নির্ভরতা নিয়ে শাওনকে জড়িয়ে কেঁদেছিল… একটা কথাও বলেনি শাওন। একবার বলেনি আমি তো আছি! আলিঙ্গনে উষ্ণতা ছিলো না কেন যেন।
ব্যাংকরাপ্ট হয়ে নিশার বাবা মরেছে শোকে পাথর শাওন হয়ে গিয়েছিল যেন।
নিশা গা ঝাড়া দিলো শাওনকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। বাকি টাকা ম্যানেজ করতে হবে যে করেই হোক! বিচিত্র এক বিতৃষ্ণা আসে মাঝে মাঝে। মনে হয় বিবাগী হয়ে কোথাও যাওয়া যেত…! হঠাৎ লন্ডভন্ড পরিস্থিতিতে দম বন্ধ হয়ে আসে।
কিভাবে কিভাবে যেন আবার নিজেকে শান্তও করে ফেলে!
মায়ের মুখটা মনে পড়ে!হঠাৎ অবস্থার পতনে মহিলা অর্ধ উন্মাদ তো হয়েই গেছেন নিশার কিছু হলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবেন।
একদিকে ভালো হয়েছে সোশাল ওয়ার্ক, আর কিটি পার্টি নিয়ে ব্যস্ত মিসেস আলমের এখন বেশ অবসর। এই হিসেবে মেয়ে কাছাকাছি এসেছে, পরিচিত সমাজ থেকে দুজনই বলা চলে পালিয়ে আছে যেন জেল পালানো খালাসী।
নিশা চেষ্টা করে মায়ের সামনে সহজ থাকতে তবু মাঝে মাঝে পারা যায় না। মায়ের পাগল বিলাপ যখন শুরু হয়।
খুপড়ির মত ঘরে ঠান্ডা এসির শীতলতার তৃষ্ণা হতে থাকে। নিশা তখন বাথরুমে গিয়ে পানি ঢালে মাথায় তবে সব সময় বাথরুমে পানিও থাকে না । এখনও মাথায় পানি ঢালতে মন চাচ্ছে! সেমিস্টারের বাকি টাকা জোগাড় কি করে করবে? ফোন বেজে যাচ্ছে ক্রমাগত বিরক্ত লাগছে! সংগীতা! কি চায়? হয়তো নতুন গসিপ পেয়েছে! কিন্তু এখন সে নিশাকে কেন খুঁজবে? না এখন নিশার কোন দামী হোটেলে খেতে যাবার প্রোগ্রাম থাকে, আর নাই কোন হাইপার মলে শপিং করতে যায়। এরা একসময় নিশার শপিংয়ের কোম্পানিয়ন ছিল! নিশা যেখানে মৌমাছির ঝাঁক সেখানে! শপিং, খাওয়া, বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউট, আহ! সে সব দিন গুলো……!
ফোন বেজে যাচ্ছে নিশা বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল – হ্যাঁ, বল!
– এই নিতু তুই এখনও বের হসনাই একঘন্টায় ক্রুজ ছেড়ে দেবে ডার্লিং!
– নিতু! কিসের নিতু, কিসের ক্রুজ, কি বলিস এগুলো?
– আ আ দাঁড়া তুই নিতু না…? এমা! আমি নিতুর জায়াগায় নিশাকে কল দিয়ে ফেলসি….. হি হি হি সরি দোস্তো! আসলে রুমকি তার বার্থডেতে আমাদের ক্রুজে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় গোটা ক্লাস! আমি নিতুকে ফোন দিতে যায়ে তোরে ফোন দিয়ালসি!
– হ্যাভ ফান! নিতু ফোন রেখে দিল। রুনকির সাথে ভিড়েছে সংগিতারা এখন। অথচ গত চার বছর নিশার সাথে থেকে থেকে রুনকির গ্রুপকে কম জ্বালায়নি!
যাক! কি আর করা, সংগিতাদের ও বাঁচার খোরাক লাগে, নয়তো ফ্রি শপিং দামী খাবারের ব্যাবস্থা হবে কোথা থেকে?পরজীবি প্রানীগুলো নিজেদের ব্যাবস্থা করেই নেয়! ফোন আবার বাজছে সংগিতাই!
– সংগিতা শোন, আমি এখন কোথাও যাব না, আমার এসাইনমেন্ট আছে দুটা, শেষ করতে হবে!
– আমি তোমায় কোথাও যেতে বলছি না ডার্লিং! বলছিলাম তোর ক্যামেরাটা কি আছে? মানে নিতু বের হইসে কিন্তু আমাদের কারো কাছে ডি এস এল আর নাই…. তোরটা তো পড়েই থাকে, তুই ঘরে থাকলে নিতু পিক করে নিয়ে নিত,.তুই বাড্ডা থাকিস না এখন …
– সংগিতা, ক্যামেরা দেয়া সম্ভব না! আমি বাসার বাইরে।
– ওহ! ব্যাড লাক! এনি ওয়ে ক্যামেরাটা আছে তো? না বিক্রি করে দিসো দোস্ত !
-মানে?
– না মানে তোর তো লাগছে না তাই না? ভাবলাম হয়তো সেল করবি…. এনিওয়ে সেল করলে জানাস, আমার কাছে ভালো ক্লায়েন্ট আছে!
নিশা ফোন কেটে দিল! কাটার সাথে সাথে একশো ভোল্টের বাতি জ্বলে উঠলো মাথায়! তাইতো! ক্যামেরাটা পড়ে আছে কাবার্ডের মধ্যে। একেবারে নতুন সনি এ ৯৯ সাথে লেন্স! একবছর আগেই কিনেছিল সাড়ে তিন হাজার ডলার দিয়ে মালয়শিয়া থেকে। অর্ধেকে ছেড়ে দিলেও এখন অনেক। একটা ক্যাফেটেরিয়ায় বসে নিশা দ্রুত নিজের মোবাইল নিয়ে সক্রিয় হয়ে যায় অন লাইন সেলের জন্য। যে করে হোক দুদিনের মধ্যে টাকাটা লাগবে তার….
বাড়ির গেটে বেশ জমে থাকা পানি পার করে নিশা ঢুকলো। নিশাদের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে বেশ ভিড়। নিশা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আন্দাজ করতে চাচ্ছে কি হয়েছে, নিশ্চয়ই মা আবার কিছু ঘটিয়েছে। গত সপ্তাহে গ্যাস সিলিন্ডারের সাথে গুতাগুতি করে ছিদ্র হয়ে সারা ঘর গ্যাসে ভরিয়ে ফেলেছিল। অল্পের জন্য দুর্ঘটনা ঘটেনি। আজ কি করেছে কে জানে। দরজার কাছে মানুষ এসেছে মজা দেখতে। কঠিন বিপদে এখানে মানুষ সাহায্য করতে আসে কম মজা দেখতে আসে বেশি। ফ্রিতে মনোরঞ্জণের সুযোগ কে ছাড়ে?, সারা সিড়ি ঘর ভেজা, গড়িয়ে যাচ্ছে পানি। বাড়িওয়ালি থমথমে মুখে বের হয়েছে ঘর থেকে । নিশার দিকে চোখাচোখি হলো, মহিলা খেঁকিয়ে উঠলো,
– এলাহী মানুষের এলাহী কান্ড! বাথরুমের কল ভেঙে পুরা ট্যাঙ্কির পানি শেষ করসে তোমার আম্মা! আজ আর পানি মিলবে না বলে রাখলাম। জিনিয়ার আব্বা বাড়িতে ছাতার যন্ত্রনা ঢুকাইসে, একেক দিন মা বেটির একেক নাটক! ভাড়ার তো নাম নাই আজকের পনের তারিখ পার হলো! ফুটানি আছে ষোল আনা!
নিশার গালে সারা শরীরের রক্ত উঠে গেছে। চোখের পাতার মত আল্লাহ কানের পাতা বন্ধ করার ব্যাবস্থা করলেন না কেন কে জানে। চৌকাঠে জমা হওয়া লোকের মুখের উপর দরজা দিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলো তার মা সোহানা আলম বিছানায় বসে ফুসছে, গায়ে পুরানো সিল্কের রোব!, মেয়ের চোখে চোখ পড়তেই তিনি জেদি গলায় বলা শুরু করলেন
-i m stuck with these cheap low class people!what? What are you staring at me! What should I do? I needed a hot shower for Mrs nazmuls kitty party! The hitter wasn’t working I just pulled the tap and it all came out! So cheap! ওফ! নিশু আমি মরে যাব এভাবে! তুমি কি.. ল্যান্ড লর্ডকে বলে…
-shut up আম্মু! just shut up!
সোহানা চমকে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে।
নিশা মাথায় দুহাত হাত রেখে ঝুঁকে বসে পড়েছে তার মাথা দপদপ করছে। খুব মন চাচ্ছে তার প্রাণের ফোয়ারার মাছগুলো ধরতে। তাদের গুলশানের বাড়িতে ছিল। মন খারাপ হলে ছোট বেলায় মাছগুলোর দিকে হাত বাড়াতো মাছেরা হাতে চুমু খেয়ে সব কষ্ট নিয়ে নিতো… আহারে কি হাল্কা জীবন ছিল।
চলবে…
অচিনপুর.কম/জীনাতুল কুবরা নিপা