অমিতা মজুমদার
রামপুরা, ঢাকা।
গল্পঃগন্ধরাজ ভালোবাসা
অভি এবারে এসে সোজা ঢুকেছে রূপার ঘরে। প্রথম যেবার অভির জাহাজ মোংলাবন্দরে নোঙর ফেলে সেবার কিছু না জেনেই পারভেজের পিছন পিছন এসেছিল এখানে এই বানীশান্তায়। মোংলা সমুদ্রবন্দর ছাড়িয়ে সুন্দরবন ঘিরে বয়ে যাওয়া পশুর নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সৃষ্টির আদিমতম পেশাজীবিদের নিবাস এখানে।যার আধুনিক নাম যৌনপল্লী। প্রথমবারে এসেছিল এই রূপার ঘরে। সেই থেকে কি এক অমোঘ আকর্ষণে অভি আর কোন ঘরে যায় না। সোজা চলে আসে রূপার ঘরে। রূপার সাথে তার একটা কেমন বোঝাপড়া তৈরী হয়ে গেছে। এই ঘরে তার কোন অস্বস্তি হয় না। যে সময়টুকু এ বন্দরে জাহাজ থাকে তার মধ্যে একবার হলেও সে এখানে আসে। এবারেও এসেছে। কিন্তু এসে অবধি রূপাকে কেমন অন্যমনষ্ক আর বিষন্ন দেখছে। রূপার গভীর কালো চোখের দৃষ্টিতে কেমন বেদনার ছায়া। অভি রূপার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে জানতে চায় কি হয়েছে। রূপা বলে- সে জেনে তোমার কি হবে অভি সাহেব ? তারপর বলে- আমার দিদিমার শরীরটা খুব খারাপ। এই দিদিমাই আমাকে বড় করেছে। দিদিমা চাইত না আমি এখানে থাকি, এই পেশায় আসি। কিন্তু কেন জানি না মা আমাকে জোর করে দিদিমার কাছথেকে নিয়ে এসে এখানে রাখল। আর তারপর তো আজকের আমি হয়ে গেলাম।
অভি জানতে চাইল- তোমার দিদিমা কোথায়? রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- আছে এখানেই। তুমি বিশ্বাস করো অভিসাহেব আমার দিদিমা একেবারে অন্যরকম মানুষ। এখানকার আর দশজনের মতো নয়। আর মা! সেও কিরকম যেন। আমি বুঝতে পারি মা যাই করছে, দিদিমার উপর রাগ করে করছে। শুনেছি আমার দিদিমা অনেক লেখাপড়া জানা। কিন্তু ঐ যে দেশে যুদ্ধ হয়েছিল সে সময় পাকিস্তানীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হলে তাকে নাকি মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে। কিন্তু দিদিমার মা-বাবা,আত্মীয়-স্বজন কেউ তাকে ফিরিয়ে নেয় না। দিদিমা যাকে ভালোবাসত সেও কোন খোঁজ নেয় নি। তখন নাকি দিদিমার মাথার ঠিক ছিলো না।কে একজন ভুলিয়ে তাকে এখানে এনে রেখে যায়। সেই থেকে দিদিমা এখানেই থাকে। এখানেই হয়তো কোন এক সাহেবের ভোগের ফসল আমার মা। আমিও আবার তেমনই কারও একটুখানি সময় কাটানোর পরিণতি। আমার জন্মের পর দিদিমা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আর সুস্থ হয়ে ওঠার ফলেই মায়ের সাথে তার কেমন একটা দূরত্ব তৈরী হয়। দিদিমা আমাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে চান, আর মা তাতে কিছুতেই রাজী হয় না। এই নিয়ে রোজ অশান্তি। তারপর আমি একটু বড় হলে মা আমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আমি মাঝে মাঝে যেতাম কিন্তু মা রাগ করত। আসলে আমার দিদিমাকে নিয়ে এখানে অনেক গল্প আছে। হয়তো এখানে যারা থাকে সবার জীবনেই একটা গল্প আছে। বছরের একটা সময় মানে ফেব্রুয়ারী মাসে দিদিমা ঢাকায় যাবে একদিনের জন্য। কোথায় যায়, কেন যায় অনেকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু বলেনি। যতোদিন শরীর চলত ততোদিন প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা যেতোই। আসার সময় সাথে নিয়ে আসত বই। বছর পাঁচেক আগে শেষ ঢাকা যায়। কি হয়েছিল জানি না। এসে সব বই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর মাকেও কিছু বলেনি আমায় নিয়ে। কেমন চুপচাপ বসে থাকত। খাবার দিলে খেত, না দিলেও কিছু বলতনা।
অভির কেমন কৌতূহল হলো।বলল- চলো তোমার দিদিমাকে দেখে আসি।- কি বলছ তুমি সাহেব ! অভি একপ্রকার জোর করেই রূপাকে নিয়ে ঘরের পেছনে গেল। যেখানে রূপার দিদিমা থাকে। অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার একটা ঘরে এসে দাঁড়ালো ওরা। অভি দেখে একজন মহিলা পেছন ফিরে কেমন কুঁজো হয়ে শুয়ে আছে। শোয়া মানুষটার বয়স আন্দাজ করতে পারছেনা। ময়লা বিছানায় আরো বেশি ময়লা একখানা কাপড় পরনে মানুষটিকে দেখে অভির কেমন বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল। একটা টুল টেনে অভিকে বসতে দিয়ে রূপা শোয়া মানুষটার গায়ে হাত দিয়ে ডেকে তুললো। পাশফিরে শুয়ে নেশাগ্রস্তের মতো চোখ খুলে বললেন- কি হয়েছে ?
অভি মুখখানা দেখে কেমন চমকে গেল। শিশুর মতো সরলতায় ভরা মুখখানি দেখে অভির মন থেকে সব ঘৃণা, সংকোচ দূর হয়ে গেল।
-দিদিমা, ও অভি যার কথা তোমাকে বলেছিলাম। তুমি দেখতে চেয়েছিলে। ও ঢাকায় থাকে।
ঢাকা নামটা শুনে কেমন আচ্ছন্নের মতো বিড়বিড় করতে লাগলেন, ক্যাম্পাস, টিএসসি, কার্জন হল, শহীদ মিনার, খোকা… । নানা খোকা না মিষ্টার পারভেজ আহম্মদ চৌধুরী, মন্ত্রী, সুন্দরী বউ, কি সুন্দর ছেলে মেয়ে…।
অভির কানে পারভেজ নামটা যেন গরম শীষা ঢেলে দিল। এটা যে তার ছোটদাদুর নাম। মায়ের কাছে শুনেছে দাদু নাকি বড় মুক্তিযোদ্ধা। নিজের জীবন পণ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে।একাত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন দাদু। ছোটবেলায় বড়দাদীকে মানে অভির বাবার মাকে দাদার সাথে বলতে শুনেছে খোকা একবারের জন্যও মেয়েটার খোঁজ নিলনা, কাজটা কি ঠিক করেছে ! তখন বুঝেনি আজ একঝটকায় বিদ্যুৎ চমকের মতো তার চোখে পষ্ট হয়ে গেল সেদিন বড়দাদী কি বলতে চেয়েছে ! কোন মেয়ের কথা বলতে চেয়েছে?
দিদিমা মাথার কাছে হাতড়ে একটা চাবি বের করে দিল রূপার হাতে। জড়িয়ে জড়িয়ে যা বলল তাতে বোঝা গেল, বাক্সে একটা পুঁটুলি আছে। তাতে একটা আঙটি আছে। সেটা বের করে যেন অভিকে দিয়ে দেয়। আর অভি যেন ঢাকায় কোন এক পারভেজ আহম্মদ চৌধুরীকে খুঁজে তার কাছে আঙটিটা পৌঁছায়। রূপা আঙটিটা বের করে অভির হাতে দেয়। অভি কেমন যন্ত্রচালিতের মতো আঙটিটা হাতে নেয়। সে একবারের জন্যও বলতে পারেনা আমি কি করে পারভেজ চৌধুরীকে খুঁজে পাবো? তার কেন যেন মনে হয় এ তার ছোটদাদুই হবে। এক পলকে দেখে নেয় আঙটিটায় নাম লেখা আছে পারভেজ। তারপর বাইরে এসে রূপাকে বলে -আজ আর থাকবোনা। নিজেকে কেমন ছোট মনে হচ্ছিল রূপার সামনে। তার মনে হচ্ছিল আমাদের মতো যারা ক্ষনিকের আনন্দের জন্য এই বানীশান্তার মতো জায়গায় আসি, রূপাদের সাথে ভালোবাসার খেলা খেলে আবার ফিরে যাই নিজের সাজানো ভুবনে। তারা কেউ কি জানি রূপারা কেন রূপা হয়ে ওঠে?
অচিনপুর/ জীনাতুল কুবরা নিপা