খুলি

শাহাদুল চৌধুরী
ডালাস, টেক্সাস, ইউএসএ।

ছোট গল্প: খুলি

(রেবেকা সিরিজের ইএসপি গল্পটির পরের পর্ব)

(১)
ন্যাশভিল শহরটি আমেরিকায় গানের জন্য বিখ্যাত। ভাগ্যান্বেষণে অধিকাংশ উঠতি গায়কেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে এই শহরের পানে পাড়ি দেয়। এই শহরে পৌঁছানোর পরই অধিকাংশ বিখ্যাত কান্ট্রি সিঙ্গারদের নাম ফাটতে শুরু করে। সেই হিসেবে এটিকে কান্ট্রি সংয়ের মক্কা বলা যেতেই পারে। রেবেকা যে কারণে ন্যাশভিলের পানে ছুটে চলেছে তার কারণটি অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। রায়হান নামের একটি ছেলের সাথে সে ভীষণ অন্যায় করেছে। সদ্য পরিচিত হওয়া এই ছেলেটি হিউস্টন থেকে উড়ে এসেছিল তার সাথে এই সপ্তাহান্ত একসাথে কাটাবে বলে। কথা ছিল তারা মেম্ফিস টেনেসিতে এলভিস প্রিসলির বাড়িটা দেখতে যাবে। বাড়িটার মূল দরজার গ্রিলে একটি গানের নোট খোদাই করা রয়েছে। ঠিক ছিল সারা সন্ধ্যা সেখানে বেরিয়ে রাতে যাবে বিবি কিং এর কাফেতে ডিনার করতে। কিন্তু বিধিবাম। তাকে সব পরিকল্পনা পন্ড করে ক্লার্ক্সভিল যেতে হয়েছিল আসিফের মেয়েটিকে সাহায্য করতে। সেই সমস্যা সমাধান করে সে যখন ন্যাশভিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, তখন সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। সপ্তাহান্ত হবার কারণে পথে তেমন একটা ভিড়ভাট্টা ছিল না। সে যখন ন্যাশভিল এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাল তখন বিকেল মাত্র শুরু হয়েছে। হিউস্টনের টিকিট কেটে সে যখন যাত্রীদের ওয়েটিং রুমে এসে বসলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। ছেলেটি যেমন তাকে চমকে দিতে হঠাৎ করে ন্যাশভিল এসে হাজির হয়েছিল, সেও ঠিক করেছে তেমনি হঠাৎ করে হিউস্টন গিয়ে ছেলেটিকে চমকে দেবে।

(২)
কিন্তু সেই ওয়েটিং রুমে, সেই শেষ বিকেলে তার জন্য আরেকটি বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। যাকে চমকে দিতে সে হিউস্টন যাচ্ছিল, সেই রায়হান সেখানে মাথা নিচু করে বসে তার ফোন চেক করছিলো। তাকে দেখে রায়হান ভূত দেখার মতো চমকে উঠল,
-তুমি এখানে? কোথায় যাচ্ছ?
-বলতো দেখি, আজকে তোমার অনুমান শক্তির পরীক্ষা হয়ে যাবে।
-আমি কি করে বলব? হয়তো তোমার কোথাও কনফারেন্স আছে।
-ঠিক ধরেছো, আমার ছয় ফিট লম্বা ঝাঁকড়া চুলের একজনের সাথে কনফারেন্স আছে হিউস্টনে।
-যাহ্, তুমি আমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলে?
-না আমার হিউস্টনে অন্য যে বয়-ফ্রেন্ড আছে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম, তুমি আসলে একটা বুদ্ধু।
-আমার যে কি ভালো লাগছে না, কালকে তুমি যখন বললে, Houston we got a problem, আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেছিল। এখন ভীষণ ভালো লাগছে। কিন্তু কাল সকালে যে আমার কাজ।
-তুমি তোমার কাজ করবে, কাজের শেষে আমরা কোথাও বেড়াতে যাব। তোমাদের হিউস্টনে দেখার মত কি আছে?
-তুমি কি সমুদ্র পছন্দ করো? অল্প দূরে গ্যালভাস্টন আইল্যান্ড রয়েছে। সেখানে বেড়াতে যেতে পারি।
-ডান। কাল সারাদিন আমি ঘুমাব। তুমি কাজের শেষে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।
-তুলে নিয়ে যাব মানে, তুমি আমার বাসায় থাকবে না?
-না রে, আমি আসলে হোটেল বুক করে ফেলেছি। আজ রাতে সেখানে গিয়ে গলা পর্যন্ত পানিতে গা ডুবিয়ে সারারাত সুইমিংপুলে কাটাবো। জাকুজির জেট স্প্রেতে একটু মেসেজের মত নেব।
-আমার বাসায়ও কিন্তু সুইমিংপুল রয়েছে, সাথে একটা ছোট্ট জাকুজিও রয়েছে। আমার শহরে আসবে আর আমার বাসায় থাকবে না তা কি হয়?
-কেন হবে না, তুমি যে আমার শহরে এসেছিলে, আমি কি তোমাকে আমার বাসায় থাকতে বলেছি? তাছাড়া আমি তোমার জাকুজি এত ব্যবহার করব, যে পানির বিল দেখে তুমি বিরক্ত হয়ে যাবে, তবে আজ না।
-এ কথার মানে কি?
-That is for me to know and you to find out. And I’m giving you all night to sleep on it. If you can figure it out, you will be rewarded. তুমি কি জানতে চাও তোমার পুরস্কার কি হতে পারে? না থাক, তাহলে সারপ্রাইজ ফ্যাক্টর নষ্ট হয়ে যাবে।
(৩)
ওরা যখন হিউস্টনে পৌঁছল তখন রাত গভীর হতে শুরু করেছে। রায়হান রেবেকাকে যখন হোটেলের লবীতে নামিয়ে দিল, তখন হোটেলের লবীর গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটিতে মধ্যরাত্রির ঘন্টা ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করে দিয়েছে। চেকিংএর পর রেবেকা যখন জানতে পারল আজ রাতের মত সুমিংপুল বন্ধ , তখন সে যারপরনাই হতাশ হলো। সে পুরোটা পথ ভেবে এসেছিল, হোটেলে পৌঁছেই সুইমিং পুলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকবে।

(৪)
পাঠক, আপনারা কি সেই বৈজ্ঞানিকের গল্পটা জানেন, যার দুটো কুকুর ছিল। একটা বড় কুকুর আর একটা ছোট কুকুর। দুটো কুকুর একসাথে উনার গবেষণাগারে ঢুকে ভীষন ঝামেলা করতো। তাই উনি দুটো দরজা বানিয়েছিলেন।পরিকল্পনা ছিল, সকালে ছোট দরজাটা খুলে উনি ছোট কুকুরটা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলবেন, আর বিকেলে বড় দরজাটা খুলে বড় কুকুরটা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলবেন। সকালে সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হল। ছোট কুকুর ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলল, আর বড় কুকুরটি ছোট দরজা কারণে ভিতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু বিকেলবেলা যখন বড় কুকুরটিকে ঢোকানোর জন্য বড় দরজাটা খোলা হল, তখন বড় কুকুরটির সাথে সাথে ছোট কুকুরটিও ভেতরে ঢুকে অতীতের মতোই গবেষণাগার তছনছ করে ফেলল। বৈজ্ঞানিক কিছুতেই বুঝতে পারলেন না, সকালে তার লজিক কাজ করেছে, কিন্তু বিকেলে কেন করল না? খুব যারা বুদ্ধিমান তারা অতিরিক্ত ভাবাভাবিতে সহজ ব্যাপারগুলো জটিল করে ফেলে।

(৫)
এখানেও তাই হলো। রেবেকা তার বাড়ির পানির বিল কিভাবে বাড়াবে, এইটা নিয়ে বেশী ভাবা ভাবিতে রায়হান ব্যাপারটা জটিল করে ফেলল। রায়হান যখন তাকে দেয়া ধাঁধার সমাধান বের করতে পারল তখন গভীর রাত। এই কথাটা দিয়ে রেবেকা তাকে জানাতে চেয়েছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রায়হান রয়েছে। একদিন তারা এক ছাদের নিচে থাকবে। এক ভীষণ মিষ্টি আত্মতুষ্টিতে তার মনটা ভরে গেল। সারাদিন কাজে তার একটুও মন বসছিল না। বারবার খালি সেই বাংলা গানটির কথা মনে পড়ছিল, সন্ধ্যা কেন এত দেরি করে?

(৬)
সব প্রতীক্ষাই একসময় শেষ হয়, এটাও হল। রায়হান যখন রেবেকাকে তুলে নিতে আসলো তখন সূর্য মাত্র নম্র হতে শুরু করেছে। ওরা যখন গালভেস্টন আইল্যান্ডের উপকণ্ঠে পৌঁছাল, তখন চারদিকে অন্ধকার করে সবে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরটিতে। যারা কখনো সমুদ্রের পানিতে শেষ বিকেলে সূর্য ডুবতে দেখেননি, তারা ভাবতেই পারবেন না কি মনোরম একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন থেকে আপনি বঞ্চিত হয়েছেন।

(৭)
খুব ছোটবেলায় একবার রেবেকা বাবার সাথে দেশে বেড়াতে গিয়েছিল। তারা লাবনী সমুদ্র সৈকতে বসে সূর্য ডোবা দেখছিল। সূর্যটা একটা অর্ধেক কমলার গোলার মতো একটু একটু করে পানির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। ওর বাবা রেবেকাকে বিভ্রান্ত করার জন্য, আঙ্গুলটা সেই আধা ডুবা সূর্যের উপর দিয়ে একটু একটু করে নীচের দিকে চাপ দিচ্ছিল। ভাবখানা এই যেন তার নির্দেশেই সূর্যটা পানির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। রেবেকা পুরো প্রক্রিয়াটা চুপচাপ দেখল। সূর্যটা যখন পুরোপুরি পানির মধ্যে মিলিয়ে গেল, তখন ও বাবার দিকে মুখ তুলে বলল,
-do it again, Daddy.
ছোটবেলার সে কথা মনে করে, রেবেকা নিজ মনেই হেসে উঠল। তারা সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমিতে হেঁটে যাচ্ছিল পাশাপাশি। হঠাৎ রেবেকাকে হাসতে দেখে রায়হান জিজ্ঞেস করল,
-হাসছো যে?
-না, হঠাৎ ছোটবেলার একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
-আমি কিন্তু তোমার ধাঁধার রহস্য বের করে ফেলেছি।
-বের করে ফেললে বল।
-পুরস্কার দেবে তো?
-ঠিক হলে দেবো।
-প্রমিস?
-প্রমিস!
-তুমি খুব শীঘ্রই হিউস্টনে মুভ করে চলে আসবে। এবং এসে উঠবে আমার বাসায়। আমরা বাকিটা জীবন একসাথে সুখে-শান্তিতে কাটাবো। Like a fairy tale ending, happily ever after!
-এটা ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে কেন আসতে হবে? তুমি কেন আমার বাসায় আসবে না?
-উত্তর খুব সহজ, আমাদের দুজনের বিয়ের কারণে আমেরিকার সরকার তো আর নাসা হিউস্টন থেকে ন্যাশভিল এ মুভ করাবে না, কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে তোমার প্র্যাকটিস এখানে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারো।
-তোমার যুক্তি আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি কি তোমার পুরস্কারের জন্য প্রস্তুত?
-I cannot wait any longer.
-The wait is over. তুমি চাইলে আমার হাত ধরে এই বেলাভূমিতে হাঁটতে পারো। যেহেতু আমার ত্রিশ বছর বয়স, তুমি হয়তো ভাববে আমি অতীতে অনেকের সাথেই এভাবে হাত ধরে সমুদ্রপাড়ে হেঁটেছি, কিন্তু সত্যিটা হলো পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম, নিজের জীবনের দিকে তাকানোর কোন সময়ই আমি পাইনি।
এই কথা বলে রেবেকা যখন ওর হাতটা রায়হানের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করেই ওর মুঠোফোনটা বেরসিকের মত বাজতে শুরু করলো।
(৮)
কলার আইডিতে কলারের নাম দেখে রেবেকার ভ্রু কুঁচকে গেল। আসিফের মার নাম উঠে আসছে। তবে কি ডলির আবারো কোনো সমস্যা হলো? খুব আতংকিত হয়ে রেবেকা ফোনটি ধরল। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসলো তিনি ডলির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তিনি ফোন করেছেন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপারে। তার খুব কাছের এক বান্ধবীর মেয়ে দিন দুয়েক আগে এক সন্ধ্যাবেলা ভীষণ ভয় পায়। ভয়ের থেকে মেয়েটির জ্বর চলে এসেছে। আতঙ্কে কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মেয়েটিও তার মতো টেক্সাসেই থাকে। তার বাসা থেকে আধা ঘন্টা দূরে আরভিং টেক্সাস বলে একটি শহরে।রেবেকা টেক্সাসে বেড়াতে এসেছে শুনে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন। তিনি ভীষণভাবে অনুরোধ করলেন রেবেকা মেয়েটিকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা। তার ধারণায় রেবেকা-ই একমাত্র পারবে মেয়েটিকে এই মানসিক অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসতে। তিনি আজ সকালেই তার ছেলের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছেন রেবেকা আসিফকে তার সারা জীবনের সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে এসেছে।

(৯)
আপনাদের মধ্যে যারা চারটি চুলায় রান্না করেছেন, লক্ষ্য করে দেখবেন যে সব রান্না জরুরী নয়, যেমন পানি সিদ্ধ করা, আমরা কিন্তু পিছনের চুলায় করি। ইংরেজিতে যাকে বলে putting it on the back burner. ফোন পেয়ে রেবেকার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তাকে রায়হানের সাথে এই কাজটি আরেকবার করতে হবে, আজকের সন্ধ্যাটি সংক্ষিপ্ত করে এখনই তাকে আর্ভিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।

(১০)
যাকে নিয়ে এত চিন্তা সেই রায়হান কিন্তু ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিল। ও বলল,
-দেখো রেবেকা, এখন যদি মহাকাশে ভাসতে থাকা কোন স্যাটেলাইটে সমস্যা দেখা যায়, তবে আমাকে এই বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে অফিসে ছুটতে হবে। সবার কাজই সবার কাছে জরুরী। তুমি যাও, কিন্তু ডালাসের শেষ ফ্লাইটটা মনে হয় চলে গেছে! তুমি চাইলে আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে গাড়ীটা নিয়ে চলে যেতে পারো, আমার আরো একটা গাড়ি আছে, সেটা নিয়ে আমি কালকে কাজে যাবো। তোমার কাজ শেষ হলে ফিরে এস। We will start our date, wherever we left off.

(১১)
আসিফের মায়ের দেয়া ঠিকানা অনুসরণ করে রেবেকা যখন মেয়েটির অ্যাপার্টমেন্টটিতে এসে পৌঁছল তখন মধ্যরাত। মেয়েটির মা দরজা খুলা মাত্র প্রচন্ড একটা পচা গন্ধ রেবেকার নাকে এসে লাগল। যদিও মহিলাটিকে দেখে মনে হল না এই দুর্গন্ধটি তিনি পাচ্ছেন। রেবেকা পার্স থেকে রুমাল বের করে তার নাক চাপা দিল। ভদ্রমহিলা তাকে তার বেডরুমে নিয়ে গেলেন। এখানেই প্রথমবারের মতো রেবেকা তার রোগিনীকে দেখল। মেয়েটিকে দেখতে বছর কুড়ির মত লাগলেও রেবেকা আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স খুব কম করে হলেও ২২বছর। কারণ মেয়েটি মাত্র ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছে। এই বয়সের কমে এই দেশে ডাক্তারি পড়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসলো গত পরশু এই সময়ে মেয়েটি তার রুমে একটি খুলি নিয়ে পড়ছিল। সে যখন ডেস্কে বসে কোন নোট লিখছিল, হঠাৎ করে আড় চোখে লক্ষ্য করে খুলিটা নড়তে শুরু করেছে। ইসরাত একলাফে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করে। তখন খুলিটাও তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে। প্রথমে গড়িয়ে গড়িয়ে চেয়ারের গদির উপর পড়ে, তারপর সেখান থেকে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ইশরাতের দিকে আসতে শুরু করে। এই সময়ে ওর চেঁচামেচি শুনে ওর মা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। বর্ণনার এই পর্যায়ে রেবেকা ইশরাতের মাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি যখন ওর রুমে পৌছলেন তখন কি দেখলেন?
-দেখি ইসরাত ঘরের মধ্যে দৌড়াচ্ছে, ফুটবলে যেভাবে একজন আরেকজন খেলোয়াড়কে পাস করে, ঠিক সেভাবে অদৃশ্য কেউ একজন খুলিটিকে ওর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।
-আপনিতো ব্যাপারটাকে জটিল করে ফেললেন, আপনি যদি বলতেন ওর থেকে শুনেছেন, তাহলে আমি মনে করতাম ওর কোন ভুল হয়েছে, কিন্তু এখানে দুজন মানুষ ব্যাপারটা দেখেছে। যাই হোক তারপর আপনি কি করলেন?
-আমি ওর কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে ও অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি ওকে সেই মেঝেতে পড়া অবচেতন অবস্থায় টানতে টানতে আমার রুমে নিয়ে আসি। আর দরজাটা বন্ধ করে দেই। তবে খুলিটা অনেকক্ষণ ঘরের বিভিন্ন কোনায় বাড়ি খাচ্ছিল, সেই শব্দ আমি বেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেয়েছি। তারপর একসময় চুপচাপ হয়ে যায়।
-সেটা কখন?
-আমি সঠিক বলতে পারবো না, কারণ আমি ইশরাতকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। ভয় পেয়ে ওর ভীষণ জ্বর চলে আসে। আমি সারারাত মাথায় পানি দিয়ে সেই জ্বর নামাই।
-এখন কি ওর জ্বর কমেছে?
-না জ্বর নাই, তবে কোনো কথা বলছে না, কিছু খাচ্ছে না।
-এটা হয়, ও একটা ভীষন শক এর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। কিছু মনে করবেন না ,আপনাদের বাসায় সব সময় কি এরকম দুর্গন্ধ থাকে?
-না এটা হয়েছে ওই ঘটনার পরে, আমি তো ওর রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। দরজার নিচে দিয়ে গন্ধটা আসতে শুরু করে গতকাল থেকে।
-আপনি অনুমতি দিলে আমি আজ রাতটা ইশরাতের ঘরে থাকতে চাই। ওর রুমে কি কোনো বিছানা আছে?
-না, ও পড়ালেখা শেষ করে আমার সাথে এসে ঘুমায়। তবে ওর রুমে একটা সোফা আছে, যেটা টান দিয়ে খুললে বিছানার মত বের হয়ে আসে। আপনি চাইলে আমি সেই ফুটোন্টা টেনে বিছানা বানিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি হলে রাত্রে ওখানে থাকতাম না, আমি নিজ চোখে যে দৃশ্য দেখেছি তা ভুলবার নয়।
-একসময় আমিও ইশরাতের মত ডাক্তারি পড়েছি, কত রাত যে খুলি বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছি পড়তে পড়তে তার হিসেব নেই, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আপনাদের, আমাকে সেটা বের করতে হবে। অন্য রুমে থেকে আমি সেটা করতে পারবো না। আপনি যখন ভয় পাচ্ছেন তখন আপনার আর ওই রুমে যাবার দরকার নেই। আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নেব।
(১২)
ইশরাতের বন্ধ ঘরের দরজা খোলার পর বদ্ধ ঘরটির ভিতরে আটকে থাকা গন্ধ রেবেকার সব বোধকে আচ্ছন্ন করে দিল।তার কাছে মনে হল এই গন্ধ এই পৃথিবীর নয়, এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও এর উৎপত্তিস্থল। সে সাথে সাথে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক পরে নিল। খুলিটি তখন ঘরের কোনায় নির্জীব অবস্থায় পড়েছিল। একপা দুপা করে রেবেকার যতই খুলিটির দিকে এগোচ্ছিল, ততই সে নিশ্চিত হচ্ছিল এই গন্ধের উৎসস্থল ওই খুলিতে। সে খুলিটি দুই হাত দিয়ে তুলে ইশরাতের পড়ার টেবিলের ঠিক মাঝখানে এমন করে বসিয়ে রাখল যেন চোখের কোটর গুলো দূর থেকে দেখা যায়। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে গেল বিছানাটা বানাতে। সোফা কাম বেডটিকে যখন সে শোবার উপযোগী করে তুলল, তখন ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। সে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বাবু হয়ে বসল তখন সত্যি সত্যি ভোর হয়ে গেছে। সে ডেস্কের উপর রাখা নির্জীব খুলিটির ফাঁকা হয়ে যাওয়া চোখের কোটর গুলির দিকে তাকিয়ে এই রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু গতকাল বিকেলের পর থেকে তার উপর দিয়ে অনেক ঝক্কি ঝামেলা গেছে। ক্লান্তিতে তার চোখদুটো বুজে আসছিল। ভোরের আলো ফুটবার কিছু পর, কখন যে তার চোখদুটো লেগে এসেছিল তা সে টেরই পায়নি। তার সেই তন্দ্রা যেমন হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করে চলে গেল একটি বিশেষ শব্দে। টেবিলের উপর হঠাৎ করেই সেই নির্জীব খুলিটির মাঝে প্রাণের সঞ্চার হলো। মহিলা ঠিক যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই খুলিটি একবার ডানদিকে আর একবার বাম দিকে হেলতে শুরু করলো। তারপর উনার বর্ণিত রোড ম্যাপের মত প্রথমে টেবিলটির সামনে রাখা চেয়ারটির গদিতে আছড়ে পড়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে রেবেকার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

(১৩)
এখানে ঘটনা একটু অন্যরকম হলো, ইসরাত মেয়েটি এই পর্যায়ে দৌড়াতে শুরু করেছিল, আর রেবেকা বিছানা থেকে নেমে খুলিটির দিকে এগিয়ে গিয়ে খুলিটির ফাঁকা হয়ে যাওয়া কোটর দুটোতে আংগুল ভরে ওর মুখের কাছে নিয়ে আসলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য। এই সময় কিছু একটা রেবেকার আঙ্গুল কামড়ে ধরল।

(১৪)
আপনারা কি কখনো কাউকে বোউলিং খেলতে দেখেছেন? সেখানে একজন খেলোয়াড় যেমন বোলিং বলটিকে দূরে রাখা পিনগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে, রেবেকাও ঠিক তেমনই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে খুলিটিকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারল। উদ্দেশ্য খুলিটি ভেঙে দেখা ভিতরে কি ছিল যা তাকে কামড় দিল। সে যা আবিষ্কার করল তা তাকে চিন্তিত করে দিল। খুলিটি ভাঙ্গার পর ভেতরে দুটো বাচ্চা ইঁদুর পাওয়া গেল। একটা জীবিত একটা মৃত। জীবিত ইঁদুরটি মুহূর্তের মধ্যে ঘরের কোনায় একটা ফুটোর ভেতর দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেয়ালে ঢুকে গেল।

(১৫)
এখন রেবেকার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না সে রাত্রিতে কি হয়েছিল। এই মৃত ইঁদুরটি সেই রাত্রে ইসরাত নোট নেবার সময় কোন এক ফাঁকে ইশরাতের দৃষ্টির অগোচরে খুলিটির ভেতরে ঢুকে যায়।তারপরে কী হয়েছে আপনারা আন্দাজ করতে পারেন। পুরো ঘটনাটা মা, মেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করে রেবেকা যখন পার্শ্ববর্তী হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে এসে ভর্তি হল, তখন সকাল হয়ে গেছে। ইঁদুরের কামড়ের মত তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্য তাকে যে হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য করা হবে এটা তার ধারনার বাইরে ছিল। সে ভেবেছিলো কোন ইনজেকশন দিয়ে তারা তাকে ছেড়ে দেবে, জরুরী বিভাগ যে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য ২৪ ঘন্টা হাসপাতালে আটকে রাখবে, এটা তার পরিকল্পনায় ছিল না। সে যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল তখন বুধবার মধ্যদুপুর। আমাদের দেশে যেমন দুইটা বড় উৎসবের দিন হল ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহা, তেমনি আমেরিকার দুটো উৎসবের দিন হল বড়দিন আর থ্যাঙ্কস গিভিং। বড়দিন কবে উদযাপন করা হয় আপনারা জানেন, তবে থ্যাঙ্কসগিভিং উৎসব নিয়ে আপনাদের কিছু বলা প্রয়োজন। বড়দিনের প্রায় মাসখানেক আগে নভেম্বর মাসের শেষ দিকের এক বৃহস্পতিবার তারা এই উৎসবটি পালন করে। এই দিনে পরিবারের সদস্যরা মধ্য দুপুরে একটি বনমোরগ সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন করতে করতে একে অপরকে ধন্যবাদ জানায় তাদের জীবনে আসার জন্য।

(১৬)
রেবেকা যখন রায়হানের বাড়ি কলিংবেলে হাত ছোঁয়ালো, কাকতালীয়ভাবে তখন মধ্যদুপুর। রায়হান ওভেন থেকে সারা সকাল ধরে রান্না করা থ্যাঙ্কসগিভিং এর বনমোরগটি বের করছিল। সে ভেবেছিল অন্যান্য থ্যাংকস গিভিংয়ের মত আজকের মধ্যাহ্নভোজন তাকে একলাই করতে হবে। অসময়ের অতিথি দেখে সে যারপরনাই খুশি হল। রেবেকা ওকে চোখ নাচিয়ে বলল,
-তুমি আমাকে তোমার বাসার জাকুজি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলে, আমি কি এখন তোমার দেয়া সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি? ভেবেচিন্তে বলো কিন্তু, কারণ আমি কিন্তু অনেক পানি নষ্ট করি। পরে অনেক টাকা বিল আসলে আমাকে বলতে পারবে না কিন্তু!

(১৭)
এ পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তার মধ্যে অন্যতম হলো শিশুর হাসি। বয়সের সাথে সাথে এই সুন্দর জিনিসটা আমরা হারিয়ে ফেলি, কিন্তু কিছু কিছু মানুষের হাসির মধ্যে শিশুর সরলতা রয়ে যায়। রায়হান তাদের একজন। রেবেকার কথায় তার মুখে যে হাসি ফুটে উঠল, তা দেখে রেবেকার মনে হল এমন একটা মানুষের পাশে সারাটা জীবন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেয়া যায়।

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa/%e0%a6%87-%e0%a6%8f%e0%a6%b8-%e0%a6%aa%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%9c-%e0%a7%a8%e0%a7%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation