ক্ষুধা

আহমেদ ইমতিয়াজ নীল
পান্থপথ, ঢাকা।

ছোটগল্প: ক্ষুধা

‘এমভি গ্লোবাল প্রোগ্রেস’- নামের জাহাজটিতে তপু ক্যাডেট হিসাবে জয়েন করেছে প্রায় সাড়ে আট মাস আগে। একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে, জীবনের প্রথম জাহাজ, তপুর প্রথম বিদেশ দেখা। ও জয়েন করেছিল মালোয়েশিয়ার কেলাঙ পোর্ট থেকে। তারপর ইন্দনেশিয়ার জাকার্তা, চীনের বেইহাই, দুবাইএর ফুজেরা পোর্ট, হো চি মিন ভিয়েতনাম, কেনিয়ার মোম্বাসা, তানজেনিয়ার দার-উস-সালাম, সুদান, ইয়েমেন ঘুরে তপুর জাহাজ এখন নাইজেরিয়ায়। এই কয়েক মাসে অনেকগুলো দেশ দেখে ফেললো, অনেকগুলো দেশের খাবার খেল। নতুন নতুন দেশের মানুষের সাথে, সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হলো। বাংলাদেশের মতো এই সব দেশগুলিতেও গরম আছে, ময়লা আছে, গরীব মানুষগুলো না খেতে পেয়ে কষ্ট পায়…অনেক গরিব অসহায় মেয়েকে দেখেছে হ্মুধার জ্বালায় রাত হলে শরীর বিলোতে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, শহরের প্রেমহীন কদর্য মানুষগুলো তাদের কাছে প্রেম চেয়ে দুহাত বাড়ায়। কথা বলেছে বিদেশে থাকা অনেক বাংলাদেশী শ্রমিকের সাথে, শুনেছে তাদের কষ্টের কথা, অসহায়ত্বের কথা।

দেখতে দেখতে নয় মাসের কনট্রাকট শেষ হয়ে গেল , এইতো সামনেই তপুর সাইন অফ। অনেক দিন পর দেশে যাবে, প্রিয়জন-প্রিয় মানুষগুলোর সাথে দেখা করবে, পছন্দের খাবারগুলো খাবে, ভাবতেই মন আনন্দে নেচে উঠে।

অবশেষে এলো সেই কাংখিত দিন, আজ রাতেই তপুর ফ্লাইট, দেশে ফেরার। কিন্তু আজ তপুর মন ভালো নেই। শেষ ভয়েজে চায়না থেকে ওদের জাহাজ চাল বোঝাই করে এনেছিল, নাইজেরিয়াতে সেই চালগুলো ডিসচার্জ করছিলো। অনেক সময় চালের বস্তা ফেটে অনেক চাল জাহাজে পড়ে যায়। সেই চাল সংগ্রহ করতে কিছু গরীব ছেলে মেয়ে ওদের জাহাজে আসে, তারমধ্যে একটা ছেলে আজ পা ফসকে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গেছে। আর পানিতে পড়েই সরাসরি জাহাজের তলায় চলে যায়, তপুসহ আরো কয়েকজন ছেলেটিকে উদ্ধারের প্রাণপন চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ছেলেটির লাশ, ছেঁড়া-ফাটা একটা ময়লা টুপি জাহাজের পাশে ভেসে উঠে। একটু পরেই ছেলেটার মা খবর পেয়ে ছুটে আসলো, বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠলো পরিবেশ। দুপুরে জাহাজের ডায়নিংএ ভাত খেতে বসে সেই দৃশ্যই তপুর চোখে ভেসে উঠছে, গা গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুই খেতে পারলো না তপু, একটু নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লো।

প্রায় দুই দিনের লম্বা প্লেন জার্নি শেষে তপু বাড়ি ফিরল। অনেক দিন পর তপু বাড়ি আসায়, বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব, মা অনেক কিছু রান্না করেছেন, সব তপুর পছন্দের খাবার। তপুর বোন-দুলাভাই আর ছয় বছরের ভাগ্নিটা এসেছে ওদের বাড়িতে। তপুও সবার জন্য টুকটাক গিফট আর চকলেট নিয়ে এসেছে, তপুকে পেয়ে সবাই খুব খুশি। দুপুরে বাসার সবাই একসাথে খেতে বসলো। ভাগ্নিটা সুন্দর কথা শিখেছে, বাধো বাধো গলায় তপুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মামা তুমি সাগরে কতগুলো কুমির দেখেছো?’

পাশ থেকে তপুর বোন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ রে, তোর এই কয়মাসের সাগর ভ্রমণের গল্প একটু কর, কতগুলো দেশ দেখলি? কোন দেশটা বেশি সুন্দর?’

তপুর বাবা বলে উঠলেন, ‘হুম, দেশ বিদেশ ঘুরে কি কি শিখলি আমাদের বল একটু।’

তপুর মা বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘আগে ওকে খেতে দাও, দেখছোনা ছেলেটা কেমন শুকিয়ে গেছে।’

তপুর মনে এখনও দুই দিন আগের ঘটনার রেশ রয়ে গেছে, ওই ছেলেটার লাশ, ওর মায়ের আহাজারি চোখে ভাসছে। ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে তপু জবাব দিল,

‘এতোগুলো দেশ ঘুরে যে জিনিসটা শিখলাম তা হলো, পৃথিবীতে যতগুলো কষ্ট আছে, সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো হ্মুধার কষ্ট…সারা পৃথিবী জুড়েই গরীব আর হ্মুধার্থ মানুষের হাহাকার ধ্বনিত আকাশ-বাতাস…ক্ষুধার কষ্ট অনেক বড় কষ্ট, যারা পেয়েছে, প্রতিনিয়ত পেতে থাকে…তারা জানে…এর যন্ত্রণা…’

কথা গুলো বলতে যেয়ে তপুর গলাটা যেন একটু ধরে এলো।খাবার টেবিল জুড়ে একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসলো, কেউ কোন কথা বলছে না।

ভাত মেখে লোকমাটা মুখে তুলল তপু, অনেক কষ্টে চিবোতে লাগল…

তপু জানে না নাইজেরিয়ার ওই ছেলেটা কোন ধর্মের, কি নাম… কিন্তু এখন যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো জাহাজে কুড়িয়ে পাওয়া চালের ভাত চিবোত ওর মায়ের সামনে বসে…তপুরই মতো…

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

,

Post navigation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *