কুয়েত ডায়েরি(পর্ব-ছয়)

সুরভী হাসনীন
উত্তর পীরেরবাগ, ঢাকা।

স্মৃতিকথাঃ কুয়েতের ডায়রি

পর্ব- ছয়

গত পর্বে কুয়েত নিয়ে কিতিকিতি আলোচনা করেছি। চলুন আজকে একটু খানি নিজের কথা শুনাই, সাংসারিক গপসপ করি। একটানা এই ভিনদেশী গল্পে অরুচি ধরার ভয় থাকে। তাই ছোট করে আজ একটু গল্পের আসর বসাই। সুখ-দুঃখের কথা বলি।

তারপর সেই গৃহ প্রবেশের দিনটি থেকে কেটে গেছে, অনেকগুলো মাস। মাসের পর মাস একই নিয়ম বাঁধা ছকে থাকতে গিয়ে হতাশা আসে। দেশের কথা ব্যাকুল ভাবে মনে পড়ে। হোম সিকনেস ভয়াবহ একটা বিষয়। একবার পেয়ে বসলে বের হওয়া কঠিন।

দেশে থাকতে তাড়া ছিল, কখন ডাক আসবে। সিল লেগে যাবে সবুজ পাসপোর্টের পাতায়। এখন মাঝে মাঝেই ভাবি, যতটা তাড়া নিয়ে এসেছিলাম, তার থেকেও কি বেশি টান এখন মনের মাঝে ফিরে যাবার জন্য টানেনা? টানে। জগতের অমোঘ নিয়মের মধ্যে জননী ও জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার কাছে, অন্য সকল মোহ তুচ্ছ মনে হয়।

সংসারে, সং সেজে জীবনপাত করার মত একই সাথে আনন্দ ও বেদনার কাব্য বোধহয় আর কোথাও দেখা যায় না। এই কাব্য না লেখা যায়। না একে ছোঁয়া যায়। কাব্যের পরতে পরতে, ধুলো, ব্যথা, মিল আর অমিল জমে কখনো মহাকাব্যের রূপ নেয়। একটা গোটা জীবনের শেষ পাতায়, অনুকাব্যের মত তার সব লেখা থাকে।

কিছু বিষয়ে একদম দায় ছেড়ে দেয়া ভালো। তাতে জীবনের বোঝা কমে। যাপিত জীবনের সংসার নামের ধাপে সব বিষয় স্বামী বা স্ত্রী’র মতানুসারে হলে, তাতে শান্তির চেয়ে অশান্তি হয় বেশি। যাকে যার কাজ, দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেই তাতে আনন্দ আসে। অকারণ খবরদারি করতে গেলেই সমস্যা বাড়ে। ভালোবাসায় স্বাধীনতার মত বড় উপহার আর নেই।

অর্ধাঙ্গের হাতে তাই সব সময় ঘর গোছানোর প্রাথমিক ধাপ ছেড়ে দেই। কেমন বিছানা হল, কেমন পর্দা হল, তাতে কি রং লাগল, তা নিয়ে মাথা ব্যাথা করি না। ফ্রিজ, টিভি, চুলা, খাট, এসবে আগ্রহ করি না। পাশের মানুষের পছন্দের উপর আস্থা আছে। স্বামী বা স্ত্রী শুধুই টাকা দেবার বা খরচ করার মেশিন নয়। ভরসা করে বলে দেই, যাই কিনো, আমার পছন্দ হয়ে যাবে জেনে রাখো।

তিনিও মনের আনন্দে ঘর সাজিয়ে অপেক্ষা করেন, আমাদের আগমনের। কোথাও পৌঁছানোর পর , একগাদা কাজ এমনিতেই জমে থাকে। সংসার সাজাতে হয়। গোছাতে হয়। একটা সংসারে , একটা ছোট্ট দেওয়ালেও যদি একটুকরো ছবি দেখতে পান, তো সেটা কখনো না কখনো দাম দিয়ে কেনা হয়েছিল। এখন হয়তো তাতে ধুলো জমেছে, নতুনের ভীড়ে তার খোঁজ হয় কম, তবু পুরাতন স্মৃতি হয়ে সংসারের বয়সের সাথে সাথে তারা ঘুরে বেরায়।

জীবনে নিজস্ব মতামতের, গুরুত্ব পাওয়ার থেকে যদি, গুরুত্ব দেয়া যায়, একটা সময় গিয়ে অন্য মানুষটিও আপনাকে সম্মান করবে বলে বিশ্বাস করি। তবে তার জন্য মানুষের মত মানুষ হবার প্রয়োজন।এমন যদি হয়, সবসময় মত দিচ্ছে, কিন্তু মতামত নেবার কোন প্রয়োজন নেই মনে করে যায়, তবে আলোচনা বা সমালোচনাও মাঝে মাঝে দরকারী।
এখানে সচরাচর সাংসারিক বাজার করতে কাছের শপিং মল গুলোতে যাওয়া হয়। বাচ্চাদের বিনোদনের অন্যতম বিষয় হচ্ছে শপিং। আমাদের ও। সামরিক জীবনের ব্যস্ততায়, এই সব সাংসারিক প্রয়োজন, নিজেদের করার অবকাশ কম।

এখানে বাচ্চারা মনের আনন্দে ঘোরে। আমার সীম লাগলে, তারা বেগুন এনে কার্টে দেয়। নিজেরাই মেপে নিয়ে আসে। যে সবজি আধা কেজি কিনার দরকার তা এক কেজি কিনি। মধুর যন্ত্রণা আর কি ।

ছোটটার বয়স দুই। সে তার ছোট ছোট হাত পা নিয়ে আমাদের সাথে সমান তালে বাজার করে । নিজেই পলিব্যাগ ধরে। বড় বোনকে হুকুম দেয়। তারপর হেঁটে হেঁটে বিক্রেতার কাছে যায় মাপের হিসেবের জন্য। বড় মেয়েটা খুব লক্ষী, ঘরের কাজে, বাবা মাকে যতটা পারে সাহায্য করে। শুধু ফ্রি হিসেবে, সারাদিন তাদের ঝগড়ার রেফারি হিসেবে আমার জীবন যায়।

পুরো শপিং কম্প্লেক্সের দুটো যায়গায় ওজন দেয়া যায়। আধ মানুষ সমান উঁচু একটা বিশাল ডেস্ক, তার খানিক পেছনে, ওজন মেশিন নিয়ে দুই থেকে তিন জন বসে থাকেন। দেড় ফুটের মহিলা কাস্টমার , সেখানে গিয়ে, শুধু আওয়াজ করে। সেলসম্যান তার সারা দুনিয়ার হাসি চেপে নিজে উঠে বাজার নিয়ে মেপে দেয়। দেড় ফুটি আবার কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে বাজার নিয়ে এসে কার্টে রাখে। কাউকে ধরতে দেয় না। আপনি যখনি ধরতে যাবেন, সে তার সিগনেচার খামচি, আপনার হাতে বসিয়ে দেবে।

এখন রোজা শুরু হয়েছে। একা একা ইফতার আর সেহরী করি। বাংলাদেশ থেকে তিন ঘন্টার পেছানো সময়ে, প্রতি দিনই ফোন দেই আব্বাকে। সেহরীতেও দেই। জানি,বয়স্ক মানুষ, ধরতে দেরি হয়। কখনো কথা হয়, কখনো হয় না। তবু জানি, আব্বা যখনই ফোন হাতে নেবে, দেখে ভালো লাগবে। দূর দেশ থেকে সন্তান তাকে স্মরণ করে রহমতের প্রতি বেলায়, এতটুকুই পিতামাতার চাওয়ায় গিয়ে ঠেকে এক সময়ে।

যে বীর্য ও রক্তের সমন্বয়ে, সৃষ্টিকর্তার দেয়া অফুরাণ প্রাণের ভান্ডার নিয়ে চলেছি অনির্দিষ্ট ভাগ্যের পথে, তার শুরু পিতা-মাতার থেকেই। নিজের সন্তান হবার পর বুঝি, কিসের টানে সকাল-সন্ধ্যা একটু কথা বলে গুরুজনেরা শান্তি পান।

সৃষ্টিকর্তার কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই, যে কদিন তাদের সেবা করে, কাছে রাখার সুযোগ পাই, তাই সই।কারণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পৃথিবীতে, কখন কোথায় সুদে আসলে, আমরা আমাদের আচরণ ফেরত পাবো, তার ভার সুনিশ্চিতভাবে উপরওয়ালা নির্ধারণ করে দেন। দশ বছর আগে বা পরে, আমার প্রতি আমার বংশধর তাই করবে, যা আমি আমার আদি পিতার সাথে করে যাবো।

বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা কাল বিশ্বকাপের আগে লাল-সবুজের বিজয় কেতন উড়িয়েছে। বাংলার নারী ফুটবলারের গোল ফিফা সেরা হয়েছে। এই আনন্দগুলো প্রবাসে বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। সকলকে শান্তির মাস, সংযমের মাসের শুভেচ্ছা।

চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation