কবি সুফিয়া কামালের আজ ১১৩তম জন্মদিন

বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বেগম সুফিয়া কামালের আজ ১১৩তম জন্মদিন। ১৯১১ সালের ২০ জুন তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়ি রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সূত্র: জাগোনিউজ২৪.কম

সুফিয়া কামাল একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান জমিদার খান্দানের মেয়ে ছিলেন যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত শিলাউরের সৈয়দ বংশ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার আসল নাম সৈয়দা সুফিয়া বেগম।

১৯১৮ সালে সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তার বাবা সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। ফলে তাকে তার মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। এই কারণে তার শৈশব কেটেছিল নানার বাড়িতে।

যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতো না। তার মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এই কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তার।

১১ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।

সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ওই সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন।

তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো- গল্প: কেয়ার কাঁটা। স্মৃতিকথা: একাত্তরের ডায়েরি। ভ্রমণকাহিনি: সোভিয়েতে দিনগুলি।আত্মজীবনীমূলক রচনা: একালে আমাদের কাল। শিশুতোষ: ইতল বিতল, নওল কিশোরের দরবারে। অনুবাদ: সাঁঝের মায়া-বলশেভনী সুমের্কী। কাব্যগ্রন্থ: সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, প্রশস্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, মৃত্তিকার ঘ্রাণ। কবিতা: ইতল বিতল, প্রার্থনা, হেমন্ত, জন্মেছি এই দেশে, আজিকার শিশু, ছোটন ঘুমায়, তাহারেই পড়ে মনে, মিটাতে জঠর ক্ষুধা।

পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ ছাড়াও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, সংগ্রামী নারী পুরস্কার, মুক্তধারা পুরস্কার, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল, স্বাধীনতা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করা হয়।

Post navigation

10 thoughts on “কবি সুফিয়া কামালের আজ ১১৩তম জন্মদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *