ইলিশের স্বাদ (পর্ব- এক)

ফাতেমা তুজ জোহরা
মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া।

ধারাবাহিকঃ ইলিশের স্বাদ (পর্ব -এক)

আজকের সকালটা কেমন কেমন! এই মেস বাড়ির চারতলার আমার দক্ষিণ রুম থেকে পিছনের পুকুরপাড় দেখা যায়, একপাশে বড় রেইনট্রি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ম্যাজেন্টা রঙের ফুল ঠিক পাউডার পাফের মতো, যখন ঝিরঝির করে বাতাস গাছের পাতায় কাঁপন লাগছে, মিষ্টি ঘ্রাণ পাচ্ছি রেইনট্রি ফুলের।
ছাই রঙা কেমন মন খারাপ আকাশ, তারসাথে টিপটিপ বৃষ্টি, দমবন্ধ করা আবহাওয়া, যে কোন সময় ঝর ঝর ঝরবে।
অসম্ভব বিষণ্ণতা -একই সাথে রোমান্টিক এই সকালে বড় মগ ভরা দারুণ রকম এক কাপ চা নিয়ে পাতলা নকশী কাঁথায় গা জড়িয়ে আধশোয়া হয়ে সত্যজিৎ রায়ের “প্রফেসর শংকু” পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হবে কল্পনায়। তারপর দুপুরবেলা যখন ঝুম ঝুম ঝরবে, তখন ধোয়া উঠা খিচুড়ি, সাথে ইলিশ ভাজা হলে তো কথাই নেই, নাহলেও সমস্যা নেই! আর আজ কিনা যেতে হবে কোন ফিল্ড ওয়ার্কে !
হুড়োহুড়ি করে রেডি হয়ে নিচের ডাইনিংয়ে যখন আমি, দারোয়ান জানালো, আমার গেস্ট -অফিসের ফিল্ড ওয়ার্কার বেবি।
“ম্যাডাম, আসসালামু আলাইকুম। আমি রেডি হয়ে চলে এসেছি, আজ যাবো বেগমপুর। সাথে অটো নিয়ে এসেছি।”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম,বাহ! খুব ভালো করেছ। কেমন আছো বেবি?”
“জ্বী ভালো। “
মেয়ে কাজে চটপটে, নিজের মতো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করে, মাত্র দুমাস এই এনজিও তে জয়েনিং, আমার কাজে খুব হেল্পফুল।
ভাবলাম, আজকের রুটিন জেনে নিই, কি ভেবে আর বলি নি, থাকনা এক আধটা দিন অগোছালো।
ব্রেকফাস্ট এর অর্ডার দিবো, কি ভেবে বেবিকে বললাম, আসো দুজনে নাস্তা করি, সাথে অটো ভাইকে ডাকো, সেও নাস্তা করুক, সারাদিনের কাজ, সকালে খাওয়া হেবি দরকার।
বেবি বিব্রত, হয়ত তাকে কেউ এভাবে বলেনি, তারচেয়ে বিব্রতভাব অটো ভাইয়ের চেহারা।
পাশে অটো ভাই খাচ্ছে-ভাত,আলু ভর্তা,ডাল,সিম্পল খাবার, কিন্তু কি তৃপ্তিকর আহার। মাঝেমধ্যে কিছু অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত যে এতো নির্মল মন ভালো করে, আজ এই অটো ভাইয়ের সকালের খাওয়া না দেখলে বুঝতাম না!
আমাদের খাওয়া শেষে অটোরিকশায় উঠলাম, টিপটিপ বৃষ্টি এখন বড় ফোঁটায় ঝরছে।

——
আকাশ এখনো ছাই রঙ ধরে আছে, শহরতলি ছেড়ে গ্রামের সরু পথে, পাকারাস্তা ধরে অটো চলছে, দুপাশে খোলা সবুজ মাঠ, ফসলি ক্ষেত, একটা দুইটা সাইকেল ঠুংঠুং বেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে-গায়ে প্লাস্টিক মুড়িয়ে,১২/১৩ বছরের কিশোর মাথায় কচুর পাতা ধরে গরু নিয়ে যাচ্ছে, ঘন বাঁশবন দুপাশ থেকে ঝুঁকেছে পথের উপর…..সব মিলিয়ে বেশ লাগছে, সেই কবে যখন গ্রামে যেতাম, এমন বরষার ছবি দেখেছি!
“বেবি,আমাদের আজকের কাজ নিয়ে কিছু বল।”
“ম্যাডাম, আমরা আজ যাবো বেগমপুর, প্রায় ১৫ কিমি রাস্তা, সেখানে মেম্বারের বাড়িতে নারী ও কিশোরীদের নিয়ে হেলথ এডুকেশন, তারপর আমরা ফিরবো। “
“হুম, আমি ফেরার পথেই বাড়ি যাবো, সামনে তিন দিন ছুটি আছে।”
“জ্বী ম্যাডাম।”
“বেবি, তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
“ম্যাডাম,এইদিকেই, মেম্বারের বাড়ি থেকে আধ ঘন্টার মত পথ, অটো ভাই, কবিরের বাড়িও আমাদের বাড়ির পরেই।”
“বাহ!ভালোই তো।”
আমি দুপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম।
দুপুরবেলা পৌঁছে গেলাম,স্থানীয় মেম্বারের বাড়িতে হেলথ এডুকেশন বিষয়ক কাজ, যখন শেষ হল, চারপাশ কালো অন্ধকার, ভরদুপুরে মাঝরাতের কালি গোলা অন্ধকার। বেবি বলল,”ঢল নামবে।” এই বাদলা দুতিন ঘন্টার আগে থামে কিনা কে জানে! আজ আমার বাড়ি ফেরা হবে না হয়তো।
প্রচণ্ড বাতাসের সাথে শুরু হল বৃষ্টি, মেম্বারের বাড়ির সাথের বাঁশবন মাটিতে বাড়ি খাচ্ছে, যেন কোন দানবের সামনে নতজানু কুর্নিশ। চড়চড় শব্দে ঝলকা দিয়ে বিদ্যুৎ চমক।প্রকৃতির এতো কাছ থেকে এমন ভয়াল বর্ষার রূপ দেখিনি।
“বেবি, এই বৃষ্টি, মনে হয়না কয়েক ঘন্টার আগে থামবে, কি করা যায় বলতো? “
“ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে, আজ রাতটা আমাদের বাড়ি যদি থাকেন, খুব খুশি হব, বেশি দূরে নয় আমাদের বাড়ি।।”
“হুম, সেটাই করতে হবে হয়তো।”
ঘন্টা তিনেক বৃষ্টি ঝরিয়ে যখন থামল, তখন সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই।
আমরা বেবির বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলাম, কিন্তু তার আগে আমার চাই চা, এক বড় কাপের ধুমায়িত চা।
কবির গ্রামের হাটে অটো থামালো। ঘন গরুর দুধের কড়া চা আর নোনতা বিস্কুটই যেন অমৃতসম, মাথা ব্যাথা আর ক্লান্তি থেকে মুক্তি।
আমরা যখন চা খাচ্ছি, কবিরকে বললাম,”কবির, হাটে কি পাওয়া যাবে এখন, তাহলে কিছু বাজার করে নিতাম।”
“জ্বী ম্যাডাম, মাঝেমধ্যে তো ভালই পাওয়া যায়, চলেন দেখি।”
আড়চোখে দেখি বেবিও রাজি হাসিমুখে।
খুব সাধারণ ছোট হাট, অল্প কিছু বিক্রেতা, তবে তাজা খেতের শাক সবজি। একদিকে কয়েকজন মাছ বিক্রেতা, সেদিকে যেতেই নজর গেল ইলিশে। ইচ্ছে প্রকাশ করাতে দরদাম যা করার বেবি আর কবির ই করে দুটো ইলিশ কেনা হল, সাথে অন্য আনাজপাতি।
বাজারের ব্যাগ হাতে কবিরকে খুব আনন্দিত লাগলো। আবার অটোতে বেবির বাড়ির পথে।
“কবির, আর কতক্ষণ লাগবে?”
“এইতো, আমরা প্রায় কাছাকাছি, মাগরিবের আযান যখন আমাদের গ্রামের বড় মসজিদ থেকে শোনা যাবে তখন পৌঁছে যাবো।”
চারপাশে সন্ধ্যা নেমেছে,সরু পাকা রাস্তা ধরে আমরা চলছি, ঠিক যেন বিভূতিভূষণ এর সেই অপু দুর্গার নিশ্চিন্দিপুর, আমার অন্যরকম ভালো লাগছে।
দূর থেকে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে, এই ভর সন্ধ্যায় গ্রামের মসজিদের আযান বুকের মাঝে কাঁপন ধরা আবেগ এনে দিলো, মনে হচ্ছে কত স্বল্প আমাদের জীবন, আর আমরা তুচ্ছ ছুটে বেড়াই মিথ্যার পিছে, বড়াই করি অযথা, অথচ জানিনা এক পল সামনে কি আছে!
অটো থামলো, আমরা সামনে নেমে যে বাড়িতে গেলাম, ছিমছাম গ্রামের বাড়ি, বাহুল্য নেই, কিন্তু কেমন শান্তির ছাপ।
উঠানের এক পাশে টিউবওয়েলে এক বৃদ্ধা ওজু করছেন, না বললেও বুঝলাম বেবির মা।
আজ এই অচেনা, অজানা গ্রামে এই সন্ধ্যা আমার মনে ভিন্নরকম অনুভুতি দিলো, নামাজ পড়া হয়না নিয়মিত, কিন্তু আজ আযান শুনে নামাজ পড়তে মন চাইলো।
আমি বেবিকে বললাম, “নামাজ পড়বো।”
বৃদ্ধা আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন। তারপর ওজু শেষে তিনজন মাটির বারান্দায় নামাজ শেষ করলাম, মনটা ভালোলাগায় ভরে গেলো, এই এখন আমি একজন ডাক্তার, বেবি সাধারণ হেলথ ওয়ার্কার -কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই সেই পরম স্রষ্টার সামনে নতজানু!

চলবে…

অচিনপুর/ জীনাতুল কুবরা নিপা

ইলিশের স্বাদ(শেষ পর্ব)

Post navigation