ইলিশের স্বাদ(শেষ পর্ব)

ফাতেমা তুজ জোহরা

মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া।

ধারাবাহিকঃ ইলিশের স্বাদ (শেষ পর্ব)

বেবি হাতে বোনা খেজুরপাতার পাটির উপরে সুন্দর ফুল লতাপাতা খচিত নকশী কাঁথা বিছিয়ে বালিশ আর পাশ বালিশ দিয়ে গেলো, হাতে স্টিলের থালিতে লাড্ডু জাতীয় কিছু।
“ম্যাডাম, আপনি আরাম করে বসেন, আপনার জন্য এই সামান্য নাস্তা।”
বেবি কিছুটা লজ্জিত, আমি বললাম, “তুমি এতো ব্যস্ত হবেনা তো, আমার বেশ লাগছে এমন পরিবেশে, দাও দেখি কিসের লাড্ডু এনেছ।”
সম্ভবত চালের গুড়া, ভাজা মশলা, নারকেল কুরা আর গুড় দিয়ে কড়া মিষ্টি, ঝাঁঝালো স্বাদের, খেতে ভালই লাগছে।
বেবি ছটফট করে কলপাড় থেকে পানি আর পাশের লেবু গাছের পাতা এনে গ্লাসে ঢেলে আমার সামনেই গুড় দিয়ে শরবৎ করে দিলো, টাটকা শীতল পানির শরবৎ আর লেবু পাতার ঘ্রাণ, চুমুক দিয়ে কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো! তারা খচিত বাতানুকূল ঘরের স্মুদি কি জুসে এই স্বাদ পাওয়া বিরল, কারণ, এখানে মানবিক ভালোবাসা মিশে আছে!
সারাদিন বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন ফ্যাকাসে। বাড়ির চারপাশে ঘন গাছপালায় ঘেরা।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু হল, উঠানের পাশে চারপাশ খোলা টিনের চালের হেশেল ঘর, বেবি তার মায়ের সাথে আনাজপাতি নিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কবির ইলিশ দুইটা ব্যাগ থেকে বের করে বাঁশের কুলায় রেখেছে, আমি এদিকের বারান্দায় বসে দেখতে পাচ্ছি- আবছায়া আলো আর কুপি বাতির হলদে আলো পড়ছে কবির, বেবি, বেবির মা আর তাদের সামনে থাকা আনাজপাতি ও ইলিশে! তিনজনের মুখের একপাশ আলোয় হলদে হয়ে চকচক করছে,যেন পাথরে খোদাই করা মানব ভাস্কর্য । আর এই স্বল্প আলোতে সামনের রুপালী ইলিশ যেন রূপকথার অপার্থিব কিছু।
মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবারে বড় হওয়া এই আমি, হয়তো খুব বেশি বিলাসিতা পাইনি, কিন্তু আব্বা খাবারে সৌখিন ছিলেন, ইলিশ তাঁর খুব প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল, বাড়িতে ইলিশ ছিল তাই সহজেই।
কিন্তু আজ এই নিভৃত গ্রামের এক বর্ষন শেষের এই সন্ধ্যা যেন আমার চোখে ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে, তিনজন মানব-মানবী যেন দুই ইলিশের রূপ, মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। হয়তো অনেককাল পরে তাদের আজ সুযোগ হবে রাজকীয় মাছের আস্বাদ নেয়ার!
বর্ষার পূর্ণিমারাত শুধু শুনেছি, আজ দেখছি খুব কাছ থেকে, গাছের পাতার টুপটাপ পানি ঝরার শব্দ, আর ভেজা নারকেল গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আধখানা ধূসর চাঁদ।
রান্না শুরু হয়েছে, ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, আমি একটু সশব্দেই বেবিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “বেবি, আজ কিন্তু কবির আমাদের সাথে রাতে খেয়ে যাবে।”
“জ্বী ম্যাডাম।”
কুপি বাতির ম্লান আলোতেও বেশ দূর থেকেও কবিরের আনন্দঘন মুখের হাসি দেখে ভালো লাগলো।
খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, বাতাসে কলাই ডালের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি রান্নার আয়োজন দেখছি। ইলিশ কেটে ধুয়ে লবণ হলুদ, মরিচ গুড়া মাখিয়ে বড় লাউ পাতায় মুড়িয়ে পুটুলি বেধে গরম খিচুড়ি খানিকটা তুলে হাড়িতে বাকি খিচুড়ির উপর সাজিয়ে তার উপরে বাকি খিচুড়ি দিয়ে ঢেকে ঢাকনি দিয়ে ঢেকে দিলো। বাহ! এর আগে এমন কখনো দেখিনি বা খাইনি। দেখাই যাক না কি হয়।
আমার এখন পেটে চনমনে ক্ষুধা ,সেই সকালে মেস থেকে খেয়ে বের হয়েছি, মাঝে চা আর নোনতা বিস্কুট। ভেজা বাতাসে খিচুড়ির সুবাসে ক্ষুধা আরো বেশি যেন।
রান্না শেষে সব গুছিয়ে এপাশের ঘরের বারান্দায় সাজানো হচ্ছে, আমি খুব আগ্রহী হয়ে সব দেখছি, শেষ কবে এমন গুছিয়ে সাজানো খাবার দেখেছি মনে পড়ছেনা।
আয়োজন খুব বেশি বা বিশাল কিছু নয়, মাষকলাই এর খিচুড়ি, সাথে ইলিশ লাউপাতায় পাতুড়ি, লাউপাতা পোড়া মরিচ আর পেঁয়াজ শর্ষে তেলে মাখা ভর্তা আর ইলিশের পাতলা ঝোল।
খুব যত্নে আর ভালোবাসা নিয়ে বেবির মা আমাকে স্টিলের থালিতে খাবার সাজিয়ে দিলেন।
সেই কবে থেকে মেডিকেল লাইফের হোস্টেল খাওয়া, এক আম্মা ছাড়া আর কেউ ভালোবেসে পাশে বসে পাতে দেয়নি।
আজ বেবির মায়ের হাতে সেই ছোঁয়া, মা তো মা- ই, সব মায়েরই  একই রূপ।
পাশে বেবি, কবির বসেছে, তারা অপেক্ষা করছে, আমি খাওয়া শুরু করলে খাবে।
আমি খুব যত্নে একটু মাছ ভেঙে খিচুড়ি তে নিয়ে মুখে দিলাম।
সেই সকালে ইচ্ছে হয়েছিল ঝুম বৃষ্টিতে খিচুড়ি আর ইলিশ খাবার, কে জানে কার ইচ্ছে কিভাবে পরম করুণাময় পূরণ করেন!
আজ আমার নিজের বাড়িতে বসে এখন ইলেক্ট্রিসিটির আলোয় ডাইনিং এ হয়ত খাওয়ার কথা, আমি এই মাটির বারান্দায় কুপি আর হারিকেনের হলুদ আলোতে খেজুরপাতার আসনে বসে।
আমি খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছি, গ্রামের রান্নার যে স্বাদ সেটা অনন্য, এই অল্প কিছুতে কত তৃপ্তি।
সামনে চাঁদ নারকেল গাছের আরো উপরে উঠেছে, আলোর তেজ ও বেড়েছে, বাঁশবন থেকে একটানা ঝিঁঝিঁর গান, বাতাসে খিচুড়ি আর ইলিশের ঘ্রাণ, অনেককাল পর এমন স্বাদের ইলিশ রান্না খাচ্ছি।
যত না ইলিশের স্বাদ তারচেয়ে এই আজকের রাতের গ্রামের পরিবেশ আর এই মানুষগুলোর ভালোবাসা সেই স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ!
আমি মনে মনে আবারো কৃতজ্ঞতা জানালাম সেই পরম স্রষ্টাকে!
“আমারে তুমি অশেষ করেছ…”

সমাপ্তি

অচিনপুর/ জীনাতুল কুবরা নিপা

ইলিশের স্বাদ (পর্ব- এক)

Post navigation