আরেকবার বললে খাব

শাহাদুল চৌধুরী
টেক্সাস, ইউএসএ।

গল্পঃ ১ম পর্বঃ আরেকবার বললে খাব


আজ ইশিতার ব্যাগ খুলে বিরক্তিতে ভরে উঠল আমার মন! প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরলে আমি ১ম যে কাজটি করি তা হল ওর টিচারের পাঠানো ইয়েলো ফোল্ডারটা চেক করি! সেখানেই ওর স্কুল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পাই। তবে আজকের পাওয়া তথ্যটিতে আমার বিরক্তির উদ্রেক করবার বিশেষ কারণ রয়েছে! সেখান লেখা রয়েছে আসছে সোমবার সকালে ক্লাস শুরুর আগে donuts with dad এর ব্যবস্থা করা হয়েছে!


আমি নিশ্চিত এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করার পিছনে প্রিন্সিপালের সদিচ্ছা কাজ করেছে! উনি চেয়েছেন show & tell এর মত কিছু একটা করতে, যেখানে বাবার গরবে গর্বিত সন্তানেরা সকালের নাস্তার সময় অন্য সহপাঠীদের সাথে তাদের বাবাকে পরিচিত করে গর্ব অনুভব করবে। কিন্তু এখানে মুদ্রার উল্টো পিঠের একটা ব্যাপার কিন্তু রয়েছে!


যে দেশের ৫১% বিবাহের পরিণতি হয় বিবাহ বিচ্ছেদে, সে দেশের একটি স্কুলে এই অনুষ্ঠান করার প্রচেষ্টা আমার কাছে বোকামির সামিল। কারণ ১০০ টি ছাত্রের মাঝে ৫১ জনই আসবে বাবা ছাড়া। তারা দুঃখিত হয়ে চেয়ে থাকবে সেই সব টেবিলের দিকে যেখানে তাদের সহপাঠীরা তাদের বাবাকে নিয়ে বসে নাস্তা করছে! বাবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এই সব শিশুরা সবসময় একধরনের মনোকষ্টের ভিতর দিয়ে যায়! অধিকাংশ শিশু তাদের বাবা -মায়ের বিচ্ছেদের জন্য মনে মনে নিজেকে দায়ী করে! সেখান তাদের জীবনে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করা মোটেই উচিত না!


আমার মেয়ে ঈশিতা খুবই চাপা স্বভাবের একটা মেয়ে! সে অধুনা এই কষ্টের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে! কারণ আমাদের এক দশকের বিবাহ শেষ পর্যন্ত একই দিকে মোড় নিল! আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম! আমি হয়তো আরো চেষ্টা করতে পারতাম! কিন্তু আমার কেন যেন আর ইচ্ছা করল না! কারণ হিসাব করে দেখেছি আমার এই দশ বছরের বিবাহে আমার এই আট বছরের মেয়েটি ছাড়া আর কিছুই আমি পাই নাই!


আমাদের বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে! আমার ভাই ছিলো ওর খালার পাড়ার ডাক্তার! উনি চেয়েছিলেন এই পাড়ার ডাক্তারটিকে পারিবারিক ডাক্তার বানাবেন! তারই প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি আমাদের বিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন! দুটো মানুষ যাদের কোথাও কোন মিল নেই, একদিন তারা নিজেদেরকে একই ছাদের নীচে আবিষ্কার করল!

জন্ম সূত্রে আমি প্রচন্ড জেদি হয়ে জন্মেছি! আমার মাও অসম্ভব রাগী ছিলেন! আমি তার খারাপ রিপুর পুরোটা সাথে নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছিলাম! ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমার রাগ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে আমাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিতে হয়েছিল! তখন থেকেই আমাকে বাড়ির লোকেরা আর ঘাটাত না! আর তাই বয়সকালে প্রবাসী এই ছেলেটির প্রস্তাব যখন তার খালার কারণে আসল, তখন আমার সব ভাইবোনেরা সেই সুযোগ লুফে নিল! কারণ আমার যদি দেশে বিয়ে হয়, তবে প্রায়শই আমি স্বামীর সাথে ঝামেলা করে তাদের কাছে চলে আসব! সেখানে বিদেশে বিয়ে দিলে সে ভয়টি আর থাকছে না! তাছাড়া ছেলে আমেরিকার নাগরিক! তার মানে তাদের বোনও একসময় আমেরিকার নাগরিক হয়ে তাদের আমেরিকা নিয়ে যেতে পারবে! তাদের ছেলে মেয়েরা একদিন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারবে, এটাও তাদের বৃহৎ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল!


আপনারা কখনো গৃহস্থের বিড়াল পার করার প্রক্রিয়া দেখেছেন? এক‌টি চটের ছালায় বিড়াল ঢুকিয়ে দূরে কোথাও ফেলে আসা হয়। বিড়াল যেন গন্ধ শুঁকে আবার পুরোনো বাসস্থানে না ফিরে আসতে পারে তার প্রক্রিয়া হিসেবে বিড়ালটিকে বিভ্রান্ত করার জন্য সামান্য একটু কর্পূর সেই চটের ছালায় ছিটিয়ে দেয়া হয়!

আমার আত্মীয়স্বজনরাও বিড়াল পার করবার মতো আমাকে পার করে দিল আমেরিকায়! সাথে কর্পূরের জায়গায় কাজ করল আমেরিকার নাগরিকত্ব! এদেশের নাগরিকত্বের কিছু নিয়মাবলী আছে! আপনাকে একটানা দীর্ঘদিন এদেশে থাকতে হবে! ইচ্ছা হলো আর আপনি স্বামীর সাথে ঝগড়া করে দেশে চলে যাবেন, তা হবে না! আমি আমেরিকা আসার পর দিন দিন আমাদের দূরত্বটা অনুভব করতে শুরু করলাম! লোকটার সাথে কোথাও আমার কোন মিল নেই! আমি অসম্ভব সাহিত্যমনা একটি মেয়ে! অথচ সে কবিতার কও কোনদিন পড়ে নাই! তার সাথে আমি ২ মিনিটের বেশী কথা বলার কিছু খুঁজে পাই না! বিয়েটা যদি একটি রেডিও স্টেশন হয়, তবে ওর অনুষ্ঠান শুনবার টিউনিং আমি কোন দিন করতে পারি নাই! এটা সত্যি, স্বামী হিসেবে সে আমাকে কখনো জ্বালায় নাই! ছেলেদের অনেক রকম নখরামি থাকে! হয়ত আকাশ মেঘলা হয়েছে, বাসায় ফিরবার আগে অফিস থেকে ফোন করে বলবে, এই মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে! তুমি একটু খিঁচুড়ি আর বেগুন ভাজা করে রাখতে পারবে? সাথে খুব করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে গোটা দুয়েক ডিমও ভেজে রাখতে পার! ওর যখন কিছু খেতে ইচ্ছে করে, ও নিজেই বানিয়ে নেয়! আমি অবশ্য তাতেও বিরক্ত হতাম। আমার কিচেনে কেউ ঢুকুক তা আমার ভাল লাগতো না! আসলে আমার ওকে পছন্দই হয়নি! ওই যে কথায় আছে না, যারে দেখতে নারি, তার পায়ে কি যেন একটা সমস্যা থাকে! আমারও ওর কোন কিছু আর ভাল লাগতো না! আমার এই বিরক্তি সীমা পেরিয়ে গেল এক মাঝরাতে! আমরা ‘হালদা’ সিনেমাটা দেখে মাত্র বের হয়েছি! তৌকীরের পরিচালনায় আমি যে কতটা মুগ্ধ তা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে! মা মাছের ব্যাপারটি কেমন মেটাফরিকালি ব্যাবহার করেছে তা নিয়ে কিছু উচ্চমার্গের আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে, তখন ও হঠাৎ করে বলে উঠলো, “কাল দুপুরে মাছ ভাজব! ফ্রিজে কোন বড় মাছ আছে? “ কথাটা শুনা মাত্র আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো! প্রশ্নটি করে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো উত্তরের আশায়। আমি তখন আমার জীবনের খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম, ওর কথার উত্তর দিতে পারলাম না।
আমরা যখন সিনেমা হলে ছিলাম, তখন হঠাৎ করেই কোথা থেকে এক পশলা বৃষ্টি এসে পুরো এলাকাটি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে! রাস্তাঘাট বৃষ্টিস্নাত পানিতে ধুয়ে একেবারে নতুন রুপার টাকার মতন ঝকঝক করছে! আমি সেই ঝকঝকে রাস্তার বিচ্ছুরিত নিয়ন আলোর দিকে তাকিয়ে ওকে বল্লাম, “আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারছি না! “
“কেন, মাছ ভাজা খেতে চেয়েছি, সেজন্য? আচ্ছা যাও আর কোনদিন তোমার কিচেনে ঢুকব না, এতো ছোট ছোট বিষয়ে যদি ডিভোর্স দিতে চাও, তাহলে আমি কোথায় যাই?”
“না, তোমাকে আমি এই জন্য ডিভোর্স দিতে চাই না, আসলে তোমার আর আমার না কোনদিন টিউনিং হয়নি, কিন্তু তুমি এতটাই নির্বোধ যে তুমি তা টেরই পাওনি! তুমি প্রতিদিন সকালে আমি উঠবার আগে আমার নাস্তা বানিয়ে রেখে কাজে গেছ! লান্চ করতে বাসায় ফিরে দেখেছ, আমি তখনও ঘুমাচ্ছি! কখনও জানতে চেয়েছো কেন আমি দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকি? আমি দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকি, কারণ আমি ডিপ্রেশনের রোগী! তুমি বিয়ে করার আগে যদি খোঁজ খবর করতে, তাহলে জানতে ক্লাস ফোরে থাকতে আমি কারো সাথে বনিবনা না হলে পেন্সিল কাটার ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলতাম! আমার হাতে যে সমান্তরাল কাটা দাগগুলো রয়েছে,এগুলো তখনকার! তোমার আমার প্রতি আগ্রহ এতটাই কম যে তুমি জানতেই চাওনি কোনদিন এই দাগ গুলো কিসের? “
“ দেখ, সব গল্পের দুটো দিক থাকে! আমি জানতে চাই নি কারণ ঘটনাটা আমাকে জানানো হয়েছিল আমাদের এনগেজমেন্টের রাতে! আমাকে বলা হয়েছিল তোমার চিকিৎসা করানো হয়েছে, তুমি এখন আর হাত কাট না।”
“তোমাকে এই কথা কে বলেছিল?”
“কে বলেছিল সেটা কি আর জরুরী, এত দিন পরে?”
“যে বলেছিল, সে ভুল বলেছিল! এতদিন রোগটা নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে! আজকাল বাসায় একলা থাকবার মুহূর্তগুলোতে পেঁয়াজ কাটার ছুরি দিয়ে আমার প্রায়ই হাত কেটে ফেলতে ইচ্ছা করে! তুমি যদি আমাকে ডিভোর্স না দাও তবে একদিন বাসায় ফিরে দেখবে হাতের কাটা অংশ দিয়ে বের হওয়া রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে সারা বাড়ি! তখন অন্য রকমের বিপদে পড়ে যাবে, তার চাইতে আমাকে ছেড়ে দাও! সেটাই হবে তোমার জন্য সহজ সমাধান।”

আমি ভেবেছিলাম এই কোরামিন ইন্জেকশনে কাজ হবে, কিন্তু আমার ধারণায় ভুল ছিলো! ও জোঁকের মত আমার পিছনে লেগে থাকলো। প্রতিদিন প্রতি বেলায় আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করল যে আমার সিদ্ধান্ত কতটা ভুল! আমি তখন ইন্জেকশনের ডোজ বাড়ানোর পরিকল্পনা করলাম! যেই দিন ওর ডিভোর্স ফাইল করবার কথা ছিলো, সেই দিন ও যখন ডিভোর্স ফাইল না করে খালি হাতে বাসায় ফিরলো, সেই দিন আমি সেই ডোজ বাড়ালাম!
“তুমি কি মনে করে কাজটা না করে বাসায় ফিরলে? তোমার কি ধারণা এইভাবে তাই রে নাই রে করে কাল ক্ষেপন করলে পুরো ব্যাপারটা আমি ভুলে যাব? আমি তোমাকে কতটা ঘৃণা করি, তুমি ধারণাই করতে পারবে না! তুমি জান আমি মনে মনে কি ঠিক করে রেখেছি? তুমি যেদিন মারা যাবে, আমি সেদিন তোমার লাশে থুতু দেব!”
এই পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন ধাতু গলাতে ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে! যেমন রুপা যে তাপমাত্রায় গলবে সোনার গলাবার জন্য কিন্ত আরো শদুয়েক ডিগ্রী বেশী তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে! মানুষের ক্ষেত্রেও কিন্ত তা প্রযোজ্য! এই দশ বছরে কত দুঃখের ঘটনা ঘটল, ওর বাবা মারা গেল, মা মারা গেল! কিন্তু কখনো ওকে আমি কাঁদতে দেখি নাই! কিন্তু আমার এই সামান্য কথায় ওর দুচোখ ভরে উঠল জলে! আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওর আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে! এক সময় ওর আবেগ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারল! আর্দ্র চোখ থেকে পানি বের হতে দিল না।
“এর পরে আর কোন কথা থাকে না! এত ঘৃণা নিয়ে কারো সাথে থাকা উচিৎ না! আমি কাল সকালে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! এদেশে ফাইল করার পর এরা ৯০ দিন অপেক্ষা করে, যদি দুপক্ষের কারো মত বদলায়! এটাকে ওরা কুলিং অফ পিরিয়ড বলে! যেহেতু আমাদের সেই রকম মত বদলানোর কোন সম্ভাবনা নেই, তাই এখন থেকে ৩ মাসের মাঝে তুমি ডিভোর্স পেয়ে যাবে! এটা তো জুন মাস! সেপ্টেম্বর শেষ হবার আগেই ডিভোর্স ফাইনাল হয়ে যাবে! তুমি তো অনেক বেলা করে উঠ, আমি কিন্তু কাল খুব ভোরে উঠে চলে যাব! আমার টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে রইলো, যে কোন প্রয়োজনে কল দিও! আর শোন তুমি আমার বাচ্চার মা, তোমার কোন কষ্ট হলে আমার বাচ্চাও কষ্ট পাবে! সুতরাং তুমি যেন বাকী জীবন এখনকার মতোই সচ্ছল জীবন কাটাতে পার আমি তার বন্দোবস্ত করে ফেলব খুব শীঘ্রই! তুমি ডিভোর্সের ফাইনাল ডিক্রি হাতে পাবার আগেই সেই কাগজ হাতে পাবে!
কথাগুলো বলে ও নিজের রুমে গিয়ে সুটকেস গুছানো শুরু করে দিল! আমি যে ওর সাথে এক রুমে থাকি না তা কি আপনাদের বলেছি? বাচ্চা হবার পর ওকে আমি আলাদা করে দিয়েছি এই অজুহাতে যে ওর এলার্মের শব্দে বাচ্চার ঘুম ভেঙে যাবে!
ঈশিতা যখন ওর খোঁজে ওর ঘরে গিয়ে ওকে সুটকেস গুছাতে দেখল, তখন ও যারপরনাই বিস্মিত হলো!
“বাবা, তুমি কোথায় যাও?”
“বলছি, তুমি খাবার টেবিলে গিয়ে বস!”
১০
খাবার টেবিলে ও ঈশিতাকে কি বলে তা জানার আমার অদম্য কৌতূহল হল, তাই আমি টুকিটাকি কাজের অছিলায় পার্শ্ববর্তী কিচেনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম! ও কিচেনে এসে একটা বড় প্লেটে ওদের দুই জনের খাওয়া নিয়ে গেল! মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মেয়েকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়! আসলে বাচ্চার প্রতি ওর ভালোবাসা পশু পর্যায়ের! আমার বাবাও আমাকে ভীষণ আদর করেছেন, কিন্তু ওর ভালবাসার কাছে সেই ভালোবাসা কিছুই না!
খাবার নেবার পুরোটা সময় ও কিচেনেই ছিলো আমার খুব কাছে, কিন্তু একবারও চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো না! ওর ভালবাসার মতো ওর ঘৃণাও খুবই তীব্র! আমি এই দশ বছরে প্রথম সেই ঘৃণা অনুভব করলাম!
“মামণি, তোমাকে আজ কিছু কথা বলব! কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনবে!“
“তোমাদের কি ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে বাবা?“
“ তুমি কি ভাবে জানলে?”
“মা বলেছে! কিন্তু কেন বাবা? তুমি এতো ভাল একজন মানুষ! “
“আমি ঠিক জানি না মা, নিশ্চয়ই তোমার মায়ের কোন কারণ রয়েছে, তুমি বড় হয়ে সে কথা তার থেকে জেনে নিও! এখন তো সামার! তুমি তো সামারে অনেক দেরী থেকে ঘুম করে উঠ! তাই কাল ভোরে তোমার সাথে যাবার আগে আমার আর দেখা হবে না! তুমি কিন্তু এখন থেকে সময় মতো খাবার খেয়ে নিবে, আর মাকে কখনো কষ্ট দিবে না! তোমার মায়ের অনেক কষ্ট, তুমি আর সেই কষ্ট বাড়াবে না! মনে থাকবে?“
“মনে থাকবে! কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা?“
“আমি তোমার আশেপাশেই থাকব মা, একেবারে স্পিটিং ডিস্টেন্সে! তোমার কোন দরকার হলেই
মাকে বলবে! আমি চলে আসব!“
“বাবা পরশু তো ফাদার্স ডে, কিন্তু তুমি তো কাল চলে যাচ্ছ, আমি কি তোমার গিফটটা আজকে দিতে পারব?“
“কেন নয় মা?“
ও এক দৌড়ে একটা কৌটা নিয়ে আসল! ভিয়েতনামের দোকানে এক ধরনের লিচুর ছোট ছোট জেলি ভর্তি কৌটা পাওয়া যায়, এটা তারই খালি হয়ে যাওয়া একটি কৌটা। কৌটার ভিতরে ও ৩ টি খেলনা দিয়েছে ওর বাবাকে!
“বলতো বাবা এই ৩টি খেলনা কেন দিলাম?“
“জানি না মা!“
“১মটা হল পেংগুইন, এরা শীতের দেশে বাচ্চা হবার আগে ডিমগুলো গরম রাখে, ২য়টা হল সি হর্স, এরা ছেলে হয়েও বাচ্চার জন্ম দেয়, আর ৩য়টা হল রেড ফক্স, এরা বাচ্চাদের সাথে খেলা করে! এনিমেল কিংডমের এদের কথা যখন পড়লাম তখন আমার তোমার কথা মনে পড়ল! বাইরে কি লিখেছি দেখ বাবা, আমি লিখেছি তুমি এই ইউনিভার্সের শ্রেষ্ঠ বাবা! আমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা বলতে পারতাম, কিন্তু কয়েকটি পৃথিবী নিয়ে যে গ্যালাক্সি, কয়েকটি গ্যালাক্সি নিয়ে যে ইউনিভার্স আমি মনে করি তুমি তার শ্রেষ্ঠ বাবা“

আমি কিচেন থেকে দেখতে পেলাম ও আবারও চেষ্টা করছে কান্না নিয়ন্ত্রণে আনবার। কিন্তু মেয়ের সামনে ও তা করত ব্যর্থ হল! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল!
“কাঁদছ কেন বাবা, তোমার কি গিফট পছন্দ হয় নি?“
“খুব বেশী পছন্দ হয়েছে মা, সুখে কাঁদছি মা।“
ওদের এই বিদায় দৃশ্য দেখে আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগল! তবে তার চাইতেও বেশী খারাপ লাগল ও স্পিটিং ডিস্টেন্স শব্দটি ব্যবহার করল বলে।
ও আশে পাশে থাকবে বল্লেই পারত, স্পিটিং শব্দটি কি ও ইচ্ছে করেই ব্যবহার করল? তীর একবার বের হয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই! যদিও এত নিষ্ঠুর কথা না বল্লেও বোধ হয় পারতাম! কিন্তু কিছু মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকে সেল্ফ ডেস্ট্রাকশন মেকানিজমের বীজ! নিজের ক্ষতি করাতেই এদের আনন্দ! এরা মায়ের দুধ খেয়ে পেট ভরে গেলে স্তনবৃন্তে একটা কামড় দেয়! আমি হয়ত সে রকম দুষ্ট বাচ্চাদের একজন ছিলাম! না হলে গত দশ বছর যে হাতটি আমাকে খাওয়ালো তাতেই কেন মরণ কামড় দেব?
১১
পরদিন সকালে উঠে দেখি টেবিলে আমার জন্য নাস্তা ঢেকে রেখে আমার স্বামী সারা জীবনের জন্য আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে! সকালে উঠে ওর খালি রুমে গিয়ে আমার বুকটা কেন যেন মোচড় দিয়ে উঠল! হঠাৎ করে পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে যেমন বুঝা যায়, কল খোলা মাত্র পানি পাওয়া কত সুবিধার একটি ব্যাপার, তেমনি প্রতিটি পদে আমি ওর অনুপস্থিতি অনুভব করতে লাগলাম!
আপনারা কখনো কি বাবা মায়ের উপর রাগ করে না খেয়ে ঘুমাতে গেছেন? এদিকে তাঁরা ডেকে ডেকে হাল ছেড়ে দিয়েছে! কিন্তু আপনি
ক্ষুধার কারণে ঘুমাতে পারছেন না, আবার লজ্জায় খেতেও যেতে পারছেন না! আপনি মনে প্রাণে চাইছেন ওদের কেউ একজন এসে আপনাকে আরেকবার খেতে ডাকুক।
ও চলে যাবার পর আমার সেই অবস্থা হল! সিনেমা দেখে ফিরার পর থেকে ও আমাকে বহুবার বুঝিয়েছে যে আমার সিদ্ধান্ত কতটা ভুল, কিন্তু চলে যাবার পর আর একবারও বুঝাতে আসল না!
আমাদের বারান্দায় দুটি বাহারি চেয়ার পাতা রয়েছে! বাহারি বললাম এই জন্য যে সেলুনের চেয়ারের মত এগুলো উঁচু নীচু করা যায়! বাবা-মেয়ে রাতের খাবার খেয়ে এখানে বসে কিছুক্ষণ গল্প করত! ঈশিতা সারাদিন বই পড়ে যা শিখত, হাত নেড়ে নেড়ে তা বাবাকে বলতো! আমাদের লিভিংরুম আর বারান্দার মাঝখানের দেয়ালটা পুরোটাই কাচের! টিভি দেখতে দেখতে আমি যখন ওদের দিকে তাকাতাম, আমার মনে হত আমি যেন কাবুলিওয়ালা গল্পের সেই দৃশ্যটি দেখছি, যেখানে মিনি বসে বসে কাবুলিওয়ালাকে বিভিন্ন গল্প বলছে!
এখন সন্ধ্যা হবার পর যে সময়টায় ওর বাবা অতীতে কাজ থেকে ফিরতো, আমরা সেই সময়টায় ঐ দুটি চেয়ারে বসে ওর বাবার অপেক্ষা করি, যদি পথ ভুলেও ও কোন দিন পুরোনো ঠিকানায় ফিরে আসে! প্রায় ২ মাসের মতন পার হয়ে গেছে, কিন্তু ও একদিনও এল না!
আমরা দুজনের কেউ অবশ্য ওকে নিয়ে কোন কথা বলি না, কিন্তু আজকে বলতে হলো!
“মা, আমি কি মানডেতে স্কুল স্কিপ করতে পারব?“
“কেন?“
“ ঐদিন তো donuts with dad, অন্য সব বাচ্চারা বাবা নিয়ে আসবে, আমার টেবিলে একলা বসতে আমার খুব লজ্জা লাগবে। “
“এবসেন্ট না করে তোমার বাবাকে ফোন করে দেখি, সে যেতে পারবে কিনা?“
“তুমি এটা করবে মা? আমি ভেবেছিলাম তুমি রাগ হবে।”
আমি ওকে বলতেই ও রাজী হয়ে গেল! ঠিক হলো ও অফিস যাবার আগে স্কুলে পৌঁছে যাবে সাড়ে সাতটার আগে। অন্য দিন সকালে উঠতে ঈশিতা খুবই ঝামেলা করে, কিন্তু বাবার সাথে দেখা হবে এই খুশীতে এক ডাকে উঠে গেল!
আমরা যখন ওর স্কুলে পৌঁছলাম, তখন মাথার উপর রোদ বেশ তেজী হতে শুরু করেছে! আমরা আগস্টের সেই কড়া রোদ মাথায় নিয়ে স্কুলের চৌহদ্দির ভিতরে দাঁড়িয়ে রইলাম দীর্ঘ সময়! অন্যসব বাচ্চারা গাড়ি থেকে নেমে তার বাবাদের হাত ধরে স্কুলের ভিতরে ঢুকে গেল। ওর বাবা কিন্তু এল না। এক সময় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? এখনই টার্ডি বেল দিবে। আজ থেকে মনে করবে, আমিই তোমার বাবা, আমিই তোমার মা। আস ভেতরে যাই!”
কাফেটেরিয়ার ভিতরে ঢুকে দেখি ওর বাবা কোনার একটি টেবিলে চুপচাপ বসে রয়েছে! :আমার খুব শখ ছিলো একটা ফর্সা ছেলে বিয়ে করার!ফর্সা ছেলেগুলো যখন শেভ করে ওদের গালে কেমন একটা নীল আভা দেখা যায়! কিন্তু ওর বাবা ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মানুষ! না হলে আমি বলতে পারতাম ওর বাবা কোনার একটা টেবিল আলোকিত করে বসে রয়েছে! তবে আপনাদের গল্পের মাঝে কাবুলিওয়ালার গল্প বলেছিলাম, আসুন গল্পটি শেষও করি কাবুলিওয়ালা গল্পের শেষ দৃশ্যটির সাথে তুলনা করে! সেখানে লেখক মহাশয় মিনির বিবাহের খরচ থেকে একশত টাকা কাবুলিওয়ালাকে দেন, তার নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য! এর জন্য তিনি মিনির বিয়েতে আলোক সজ্জার ব্যবস্হা করতে পারলেন না, কিন্তু তাঁর কাছে মনে হল কাবুলিওয়ালার আশীর্বাদে পুরোটা বিয়ে বাড়ি যেন আলোকিত হয়ে গেল!
আমার মেয়ে কাফেটেরিয়ায় ঢুকে বাবাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে আবিষ্কার করে যে প্রচন্ড আবেগে বাবাকে জড়িয়ে ধরল, আমার মনে হল তার ভালবাসার শক্তিতে কোনার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন টেবিলটি যেন আলোকিত হয়ে উঠল!
রচনা কাল
বাবাদিবস ২০১৮
ডালাস, টেক্সাস, ইউএসএ।

অচিনপুর ডেস্ক/ এস এস ববি

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন…

Post navigation