আফরোজা খানম
ঢাকা।
সাইকো থ্রিলারঃ অবচেতন- তিন
গত বছর শীতে মানিকগঞ্জের এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম, আত্মীয়ের বাড়িতে। দুইদিন ছিলাম সেখানে। গতানুগতিক গ্রামগুলোর মতই শহুরে হাওয়া লেগেছে। কেমন যেন গ্রাম্য ভাবটা অনেকটাই উধাও। নদী, খালে পরিণত হয়েছে। মাটির ঘরে ইট, বালি, সিমেন্টের প্রলেপ। সবচাইতে অবাক যেটা করেছে সেটা হচ্ছে, ইলেক্ট্রনিক্স নির্ভর জীবনযাপন। কিছু উন্নতি কেড়ে নেয় মায়াময় সৌন্দর্যের। মন খারাপ হলেও মেনে নিতে হয়।
বিকেলে গ্রাম হাঁটতে বের হয়েছি। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। বিদায় নিতে এখনো বেশ দেরি। সময়টাকে কাজে লাগাতেই বাড়ি থেকে আরেকটু দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টায় সামনের দিকে পা বাড়াই। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই লাউ গাছের জাংলা দেখতে পাই। তেমনি পথের ধারের এক বাড়িতে ঢুকে পড়ি, গাছ দেখার লোভে। বাড়ির কত্রী ঘরের বারান্দায় বসে ছোট কাঁথা সেলাই করছে আর পাশেই সেই কাঁথার মালিক শুয়ে আছে। জন্ম হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বড়জোড় সাত থেকে দশদিন হবে হয়তো। কোত্থেকে ১৯/২০ বছরের শাড়ি পড়া একটা মেয়ে দৌড়ে এল-
-কারে চান? কোন বাড়িত থন আইছেন?
-তোমাকে চাই। চা খাওয়াবে? পাভেল ভাইদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
-মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে, ও কাইল দেখছি আপনের গাড়ি। ঢাকার থন আইছেন। বহেন চা বানায় আনতাছি।
– অবশ্যই র চা, লেবু পাতা দিয়ে। আরেকটা জিনিস চাই, লাউশাক।
-শাক তো এহন দিবার পারুম না। এই বেলায় লাউশাক কাটা নিষেধ আছে। কাইল বিহানে আইয়েন, লাউসহ দিমুনি।
মেয়েটি দ্রুত চা বানাতে চলে যায় ঠিক যেমন দৌড়ে এসেছিল। আমি বাবুকে দেখতে বারান্দার দিকে এগিয়ে যাই। এককথায় দুই কথায় জানতে পারি, মেয়েটির নাম “ময়না”। তার একমাত্র ছেলের বৌ। বাচ্চাটি ময়নারই তবে তিন নাম্বার সন্তান। আমি একটু রাগই হই এতো অল্প বয়সেই মেয়েটির তিন- তিনটা বাচ্চা হয়েছে! যে কিনা নিজেই এক কিশোরী! কিন্তু রাগ বেশি সময় ধরে রাখতে পারি না। সেখানে ভর করে অবিশ্বাস এবং আরো তীব্র রাগ। একে একে বের হয়ে আসে এই নিষ্পাপ হাসির পেছনের ভয়ংকর গল্প।
ময়নাকে যখন বৌ করে আনে তখন তার বয়স ১৫ বছর। বিয়ের ২ মাসের মাথায়ই মা হওয়ার খবর শুনে সবাই প্রচন্ড খুশি। বাচ্চা পেটে থাকতে বৌয়ের আচরণ তেমন একটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি কারো। হঠাৎ রেগে যাওয়া, ঘুম কম, অযথাই কান্নাকাটি করা এমন আচরণ সব মেয়েরাই কম বেশি করে থাকে এই সময়ে। ডেলিভারি নরমালই হয়, বাড়িতে। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। দুইদিন পর ভোরবেলা বাড়ির পেছনের পুকুরে বাবুর লাশ দেখতে পায় সবাই। জল্পনা-কল্পনায় সবাই অনেক রকম ধারণা করে কিন্তু আসল রহস্য সবার অজানাই থেকে যায়।
এর কয়েকমাস পরে আবারও ময়নার বাচ্চা আসে পেটে। এবারও বাড়িতেই ডেলিভারি হয়, কোন রকম সমস্যা ছাড়াই। প্রতি রাতে ময়নার পাশে তার শ্বাশুড়ি ঘুমাতো বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখার জন্য। বাড়তি সতর্কতা হিসেবেই এই ব্যবস্হা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল কই?
তিনদিনের দিন সকালে বাথরুম থেকে শ্বাশুড়ি এসে দেখে ময়নার কোলে বাবু নিথর হয়ে পড়ে আছে। শ্বাশুড়ির চিৎকারে সবার ঘুম ভাঙ্গে। চারিদিকে তুমল চেচামেচি, হৈচৈ পড়ে যায় কিন্তু ময়না নির্বিকার। ময়নাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য হসপিটালে ভর্তি করা হলো। এইবার বের হয়ে এল প্রথম সন্তানের মৃত্যুর কারণ।
সাতদিনের মাথায়ই সে দিব্যি সুস্থ হয়ে ফিরে এল। কিন্তু এবার ডাক্তার বলে দিল, একটু গ্যাপ দিয়ে বাচ্চা নিতে। এতো অল্প বয়সে মা হওয়ার মত মানসিক প্রস্তুতি ময়নার এখনো হয়নি। প্রেগন্যান্ট হলেই ওর মধ্যে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। ভাল করে চিকিৎসা করানো দরকার। চিকিৎসার পর যেন বাচ্চা নেয়।
কিন্তু “চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী”। কয়েকমাস যেতে না যেতেই তৃতীয়বারের মত প্রেগন্যান্ট হয় ময়না। এবার আর কোন ভুল নয়। ময়নাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। হসপিটাল থেকে আসার দিন থেকেই বাচ্চা এবং ময়নাকে আলাদা রাখার ব্যবস্হা করা হয়। সে নিজেই নাকি বলেছে,
“তুমাগো জিনিস তুমরাই হেফাজত কর। আমার কাছে আইলেই মরব। ”
সব শোনার পর আমি উনাকে বললাম,
-আমার কাছে তো ওকে অস্বাভাবিক মনে হল না!
-দিনের বেলা ঠিকই থাহে। রাইতের বেলাই বেশি আওলায়া যায়। তুমি কি মা একটু ওর লগে কথা কইয়া দেখবা?
ময়না চা বানিয়ে এনে উঠানে একটা টুল দেয় বসার জন্য। শুধু চা দেয়নি সে। সাথে চমৎকার করে ধনেপাতা, পেয়াজ, কাঁচাঝাল দিয়ে মুড়ি বানিয়ে এনেছে। বাড়িতে উঠার সময়ই দেখেছি ছোট্ট একটুকরো জায়গায় ধনেপাতা লাগিয়েছে। আমি ময়নার সাথে কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এভাবে কারো মনে জায়গা না তৈরি করে মনের গহীনের কথা নিয়ে আলোচনা করা অপরাধের সামিল। আমি সেই অপরাধ করার জন্য নিজেকে তৈরি করলাম। হাসি মুখে ময়নার দিকে চা’র কাপ বাড়িয়ে দিলাম।
-ময়না তুমি তো চা দারুণ বানাও! ধনেপাতা কি তুমি লাগিয়েছ?
একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ময়না বলল,
-আফা যা জিগাবেন কইয়া ফালান। আমার সময় কম।
– সময় কম কেন?
-একটু পরে নিজেই বুঝতে পারবেন। আমার কওয়া লাগব না।
– এমন কেন করো তুমি? এরা তো তোমারই শরীরের অংশ।
– প্রথমডা আমার পেটে থাকতেই কইলজা খাইত। রাইত হইলেই কুটুর কুটুর আওয়াজ শুনতাম আমি। তাই রাইতের আন্ধারে পুকুরের পানিতে ডুবায় দিছি। পরেরডা খালি কানত। বড়ই ত্যাকতো লাগত আমার। বেশি সময় লাগে নাই। নাক-মুখ চাইপ্পা ধইরা ১,২,৩ কওয়ার আগেই শ্যেষ।
বলেই ময়না হাসতে শুরু করল। ওর হাসি আর এখন নিষ্পাপ মনে হচ্ছে না। এমন সময় শ্বাশুড়ি ময়নাকে ডেকে বলে,
” বৌমা, অন্ধকার হওয়ার আগেই ঘরে যাও। তোমার বিশ্রামের সময় হইছে। ”
ময়না আর কোন কথা বাড়ায় না। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে যায়। আমিও ওর পেছন পেছন এগিয়ে যাই কৌতুহল বসত। ঘরের একপাশে মাদুর পাতা, প্লেটে রাতের খাবার, পাশেই পানির জগ। এগুলো ময়নাই আগে থেকে রেডি করে রেখেছে। নিজের জন্যে। একটু দূরে একটা শিকল পড়ে আছে। সেটা নিজের পায়ে জড়ায়ে তালা লাগাতে লাগাতে ময়না আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আফা, চাবিডা আমার শ্বাশুড়ির কাছে দিয়েন। আমার কাছে থাকলেই বিপদ। আর আপনি কি আমার শ্বাশুড়িরে কইবেন? বাচ্চাডারে আমার কাছে মাঝে মইধ্যে একটু দিতে? বুকের দুধ খাওয়াইতাম। বুকডা ব্যথায় টনটন করে। দুধ পইড়া কাপড় ভাইস্যা যায়। নিজের গা ঘিন ঘিন করে দুধের গন্ধে।”
বলেই মুচকি হাসি দিল সে। গলার স্বরে ময়নার যথেষ্ট মায়ামাখা দরদ, কিন্তু হাসি আর চোখের চাহনিতে তার ছিটে ফোঁটাও নেই। সেখানে ভর করেছে ভয়ংকর খুনীর দৃষ্টি।
★ সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
সমাপ্ত
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা