সুরভী হাসনীন
ঢাকা।
গল্প: অনুরোধ (শেষ পর্ব)
সাবেরা আহমেদ বেশ কয়েকটা মেয়ের ছবি দেখেছেন। কোনটার বাবার বাড়ি ভালো তো মেয়ে দেখতে ভালো না, আবার যে মেয়ের বাবার বাড়ি ভালো, মেয়েও দেখতে ভালো, সে মেয়ের চাকরি নেই। বয়স কম, মাত্র চাকরীতে ঢোকা, বাবার অবস্থা ভালো মেয়ে চাচ্ছেন । আগের বারে শিক্ষা হয়ে গেছে। চাকরীর লোভ করে ছাব্বিশ বছরের মেয়ে এনেছিলেন, এবার একদম বাইশ কি তেইশ। সায়মনটা কেন যেন আজকাল এড়িয়ে চলছে। আসলে বিয়ে করা ছেলেতো, বিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। ঘটকের উপর ভরসা না করে, এবার চেনা পরিচিতদের মধ্যে মেয়ে দেখছেন সাবেরা। মাজা মাজা গায়ের রঙের একমাত্র মেয়ে, বাবা বিদেশে থাকা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, আত্মীয়-স্বজন ও তেমন ঠাটানো না। একে ধরলে নগদ লাভ খারাপ হবে না, বরং মেয়ের নামে ফ্লাট আছে। সায়মনের বাবা সায়মনের ডিভোর্সের চাপটা নিতে পারেনি। দেশের বাড়িতে থাকতে গেছে।
–আম্মা, মনামীকে নিয়ে আমি আলাদা বাসায় উঠব সামনের মাস থেকে।
— আল্লাহ, কি বলছিস মামুন,আমি কিভাবে থাকব। আমি বুড়ো মানুষ, তোর আব্বাও নেই, আমার যদি কিছু হয়?
–তুমি খরচ নিয়ে ভেবো না, মাসিক এখন যা দিতাম তার কাছাকাছি দেব। তবে পুরোটা দিতে পারব না, আলাদা বাসা, ম্যানটেনেন্স কস্ট থাকবে।
–ছিঃ ছিঃ, টাকা দিয়ে কি হবে আব্বা, তোরা আমার ছেলে, আমার কাছে থাকবি। আমার আর কি লাগে বল?
— আমি তোমার ছেলে এটাতেই তো আমার লজ্জা। তোমার যদি সেন্স থাকত বুঝতে, অবশ্য তোমার কাছে সেন্স আশা করা, আর শয়তানকে তসবী পড়তে বলা এক।
–মামুন! তুই এত বড় কথা বলতে পারলি? আমি কি করেছি?
কাঁদতে থাকেন সাবেরা। মামুন চুপ করে তাকিয়ে আছে। সে নিজেও জানে, মাকে কোনভাবেই এমন কথা বলা যায় না। এমনকি, সে যে চলে যাচ্ছে বয়স্ক মাকে একা ফেলে, তার গুনাহ্ হচ্ছে। তবু সে নিরুপায়। সায়মনের ঘটনার পর মনামী আবার ইনসিকিউর ফিল করছে। কি করেনি তার সাথেও আম্মা। বিয়ের পর দীর্ঘদিন মামুনকে চাকরীর জন্য মফস্বলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থাকতে হতো। ছুটিতে বাড়ি এসে দেখতো মনামী নেই, বাবার বাড়ি গেছে। আর যতবার ছুটিতে আসত, আম্মা ততবার অসুস্থ হয়ে পরত। তাই আম্মাকে রেখে শ্বশুড় বাড়িতে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে যেতো। মাসের পর মাস এমন গেছে, মামুনের সাথে মনমীর দেখা হয়নি। আর আম্মাও আসার পর মনামীর সম্পর্কে এমন সব কথা বলত, মনটাই বিষিয়ে যেতো। ফোন করো খোঁজ নেয়া দূরে থাক, মনামী যদি বাসায় আসতও, মানমীর সাথে কথা বলত না মামুন। আম্মাও সুযোগের সদ্বব্যবহার করত। সেসব দিনের ফলাফল দিয়েছে মনামী আর সে। সম্পর্কটা একদম খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে এনেছে মামুন। আব্বা আর মনমীর বাবা- মা ছিলো বলেই হয়ত তাদের সংসার টিকে আছে। মাকে কাঁদতে দেখে তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া এখন আর কিছুই করার নেই মামুনের। মাকে দেখতে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করতে পারবে না, মামুন, যেখানে সে জানে তার মা কেমন মানুষ।
মুক্ত আকাশের দিকে তাকালে চোখ ভরে কান্না পায় রায়নার। জীবনের দেড়টা বছর ভ্রম আর মিথ্যের মধ্যে সত্যটাকে খুঁজতে চলে গেছে। সায়মন ডিভোর্স দিয়েছে তাকে। কারণ দেখিয়েছে, স্বামী কর্তব্যে অনীহা, বাহিরের ঝোঁক, উশৃঙ্খলতা আর মানসিক অসুস্থতা। কোর্টের একটা শুনানীতেও যায়নি রায়না। কি লাভ? তার থেকে মুক্তি ভালো। ভাইয়া ভাবী খুব লড়তে চেয়েছিল, রায়নার অনীহায় আর কিছু করেনি। সায়মন আর ওর মাকে ও কিচ্ছু করবে না। বরং জমা দিয়ে রেখেছে ওপরওয়ালার কাছে।রায়নাই যদি বিচার করে ফেলে, তবে তিনি তার বিচার কমিয়ে দেবেন। উপরের বিচার খুব সুক্ষ, পাপ পূণ্যের পেয়ালায় এতটুকু এদিক সেদিক হয় না। তবু চাকরীতে ব্যাক করায় রক্ষা, নয়ত এত কষ্টে মরেই যেত সে। জিয়াদ ভাইকে এজন্য স্পেশাল থ্যাংকস। একজন প্রকৃত বন্ধুর মতন ভরসা আর সাহসের হাত বাড়ানো এই মানুষটারও যে জীবনে এত কষ্ট লুকানো, কাছাকাছি না মিশলে বুঝা যায় না। জিয়াদ ভাই ও খুব চেয়েছিলেন শাস্তি দিতো সাবেরাকে। একমাত্র রায়নাই পিছনে ঘুরে তাকাতে চায় না আর। হ্যান্ড ব্যাগটা খুলে একটু বিস্কিট খায়, এ ব্যাগটা কক্সবাজার থেকে কিনেছিল। ব্যাগের ভেতর পুতির দুল, আর্টিফিশিয়াল মুক্তোর মালা, চুড়ি। তাড়াহুড়োয় ব্যাগ বদলাতে গিয়ে এগুলো আর খুলে রাখা হয়নি। আয়না খুলে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। সায়মন খুব শখ করে বার্মিজ মার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিল, কিছু স্মৃতি এখনো ভুলে যাওয়া সহজ নয়। সায়মনের ভেতরটা ভালো ছিল, শুধু একটু দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসার ব্যালেন্সটা করতে জানলে হয়ত সংসারটা টিকে যেত। রায়না আনমনে লিপগ্লস লাগায়, ছড়ে যাওয়া গ্লসটা টিস্যুতে মোছে, আর বিশ্বাস, নিজের বউকে বিশ্বাস করতে পারেনি সায়মন।
আহমেদ সাহেব অনেকদিন পর নিজের বাড়ি এসছেন। গাছপালা, টুকটাক জিনিষপত্র গুছিয়ে দেবার জন্য মামুনের অফিসের একটা ছেলে এসেছে। সাবেরা বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছে আশেপাশে, কথা বলেননি। এই মহিলার সাথে জীবন কাটিয়েছেন ছেলেদের জন্য। স্ত্রী হিসেবে সাবেরা প্রাথমিক জীবনে ভালো মানুষের মুখোশ পরেছিল। যেই সন্তান হলো, আহমেদ সাহেবের ব্যস্ততা বেড়ে গেল, সাবেরা নিজের মুখোশ খুলে ফেলল। এবার হয়ত সময় এসেছে, সাবেরাকে ছেড়ে যাবার। মামুনের সাথে চলে যাবেন। সাবেরা নীরবে নিজের স্বামীকে দেখছেন, কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। সারাজীবন চুপচাপ লোকটাকে আজ তার ভয় হচ্ছে। বুদ্ধি লাগবে, ঘনিষ্ট বান্ধবী রুকায়াইয়াকে ফোন দেন।
–রুকি, শোন, তোর দুলাভাই গ্রাম থেকে ফিরেছে, একদম বদলে গেছে, কথাই বলছে না বুড়ো।
–তুই সাবধান, একটু ইমোশোনালি বুঝ দে।
–আরে কথা বললে তো, আমার সাথে কথা বলছে না। নিজের জিনিষ গুছায়, মামুনের সাথে গিয়ে থাকবে।
–বলিস কি, ছেলে তোর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সাবেরা, সামলাতে পারলি না কেন?
–মামুন তো এখন আমাকে বিশ্বাস করে না, বউয়ের কথায় চলে।
অফিস থেকে বাবার আসার খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে সায়মন, বাবাকে ফেরাতে হবে। আম্মার ওপর রাগ করে চলে যাওয়ার মানে নেই। রায়নার দোষ ছিল বেশি, ও কখনো আম্মাকে মেনে নিতে পারেনি, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য কতটুকু করেছে? সারাদিন অফিস করে এসে আম্মার সাথে কথা বললেও ওর খারাপ লাগত। বাজে মেয়ে একটা, অফিসের বসের সাথেও ঘনিষ্ট হয়ে গেছে সুযোগ পেয়ে। নিজেই তো দেখেছে সায়মন। জিয়াদ কেমন নিয়মিত আসত রায়নাদের বাসায়। রুমে ঢুকতে গিয়ে মায়ের গলা শুনে থামে, আম্মা হয়ত কথা বলছে ভেতরে, ঘুরে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেছে। রায়না আর তার সম্পর্কে কার সাথে এসব কথা বলছে আম্মা?
–বুঝলি রুকি, মোস্তফা যেদিন আসল, মানে ঐ যে এবরশন হয়ে গেল যেদিন রায়নার, আমি ইচ্ছে করে সায়মনকে বাসায় ঢুকতে দেখে রান্নাঘরে পরে গিয়েছিলাম। জানিসই তো, সায়মন আমার কিছু হলে রায়নাকে ছেড়ে কথা বলবে না। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলাম ভালো মতো।
–কিন্তু তোর ছেলের সংসারটা ভাঙ্গল।
–আরে রাখতো, মেয়ে একটা গেছে দশটা অাসবে। এবার কচি দেখে, পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে আনব। বিয়ের পরেই বাচ্চা নিতে বলব, একটা বাচ্চা হয়ে গেলে কোথায় যাবে? বয়স কম আনব, বুদ্ধি কম থাকবে। বুঝলি না, একটা পেতে গেলে আরেকটা ছাড়তে হয়।
–ঠিক বলেছিস সাবেরা, তুই পারিসও।
–সায়মনটাকে প্রথম থেকে বউয়ের কাছে ঘেষতে দেইনি, আর আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ছেলে, আর কি লাগে। বাচ্চাটা তো শুরু থেকেই চাইনি আমি, বরং এই উসিলায় দুটো আপদ একেবারে বিদায় হয়েছে, বুঝলি!
দরজা ধরে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সায়মন। নিজের মাকে এতদিন বিশ্বাস করে কি খারাপ ব্যবহার করেছিল রায়নার সাথে। রায়নাকে একবিন্দু বিশ্বাস করেনি। কতদিন রায়না নিজের মত কেঁদে ঘুমিয়েছে, সে ফিরে তাকায়নি। না খেয়ে থেকেছে, ঢং ভেবে পাত্তা দেয়নি। একটা কাপড় কিনতে গেলেও আম্মার জন্য জোর দিয়ে কিনিয়েছে, আর আজকে আম্মার মুখে এসব কথা শুনে চেনা পৃথিবীটা মিথ্যা লাগছে সায়মনের। ঘাড়ে বাবার হাতটা টের পায় সায়মন। আহমেদ সাহেব ছেলেকে হাতে ধরে নিজের রুমে নিয়ে বসান।
–দেখ, নিজের কানে শুনলি তো আজকে। তোর মা, মামুনের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিল। মামুনের সদরে পোস্টিং থাকত, ও ছুটিতে আসার আগে তোর মা মনামীকে বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিত। নিজে অসুস্থ হবার ভান করত। মামুনকে মনামীর কাছে যেতে দিত না, মনামীকেও জানাত না মামুন এসছে, সাথে মনামীর বিরুদ্ধে বাজে কথা বলতো মামুনের কাছে।
–আমাকে কখনো বলো নাই কেন আব্বা?
–তোর মায়ের বিরুদ্ধে বলতে চাইনি, ভেবেছি বড় হলে তুই বুঝবি। তোর মা একদিন মামুনের কাছে মামুনের এক বন্ধুর সাথে মনামীকে জড়িয়ে নোংরা কথা বলে, সেদিন মামুন তোর মাকে বুঝতে পারে, ওর মানসিকতা কতটা নোংরা। আর মনামীকে ও নিয়ে যায় ওর কাছে, তোর মাকে না জানিয়ে। তোর মা তখন ফোনে মামুনের কাছে মনামীর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলত, বিচার দিত। অথচ, মনামী তখন মামুনের কাছে। শোন সায়মন, তোর মা মানসিক ভাবে অসুস্থ নয়, শারীরিক ভাবে তো নয়ই। এটা বিকৃতি, অন্য কারো ভালো, সুখ দেখতে না পারার বিকৃত মনোভাব। হোক সে আপন স্বামী, ভাই, বোন, মেয়ে বা ছেলে। এসব অমানুষ কারো সুখ সহ্য করতে পারে না।
–আব্বা আমিও যাব তোমাদের সাথে। ভাইয়াকে বলব আমি।
–না, তুই থাক, তোর মা তোর জন্য মেয়ে দেখছে। এবারের সংসারটা ভাঙতে দিস না। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে যত তাড়াতাড়ি পারিস। আর রায়নার কাছে মাফ চেয়ে নিস। অন্তরের অভিশাপে গোটা জীবন পুড়ে যায়, তবু পাপ স্খলন হয় না। রায়না ক্ষমা না করলে আল্লাহ তোকে ক্ষমা করবে না।
জিয়াদ ভাই কবে যেন জিয়াদ হয়েছে রায়নার কাছে, বয়সের হেরফের যে বন্ধুত্বে বাধা পরে না তার প্রমাণ তাদের সম্পর্কটা। আগের অফিস ছেড়ে নতুন অফিসে জয়েন করেছে রায়না, ভাইয়ার বদলী হওয়ায়, মাকেও যেতে হল, নইলে ছোট্ট বাবুটাকে নিয়ে হিমশিম খাবে ভাবী। একটা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে উঠে গেছে সে। লম্বা ছুটিগুলো ভাইয়ার কাছে চলে যায়, ভাইয়ের মেয়েটাকে যখন বুকে চেপে আদর করে নিজের বাবুটার কথা খুব মনে পড়ে রায়নার। মা খুব চাপ দেয় আবার বিয়ে করতে, রায়নারও মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনকে আরেকটা সুযোগ দেবার। পরক্ষণেই ভয় হয়, যদি আবারো ধোঁকা খায় সে? পুরুষকে বিশ্বাস করে আর কত কষ্ট পাওয়া যায় এক জীবনে। কফিশপের বাইরে হালকা বৃষ্টিতে শাড়িটা বেশ ভিজে গেছে, গায়ে জড়ানোয় নারীত্বের সৌন্দর্যরূপ বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। জিয়াদ ভেতর থেকে অপলকে দেখতে থাকে রায়নাকে, মেয়েটা মানুষ হিসেবে এত ভালো, অথচ একটা সুন্দর জীবন পেয়েও সইল না।
–দেরী হয়েছে?
–একদম না। একটা খবর আছে।
–কি? প্রমোশন? জিয়াদ আগে বলতে? একটু সেলিব্রেট করতাম
–বন্ধু আমি প্রেমে পরেছি। মেয়েটার সাথে তোমাকে আজকে পরিচয় করাব।
–সত্যিইইই… জায়গা ভুলে চিৎকার দিয়েই নিজের ভুল বুঝে জিভ কাটে রায়না। এক স্বর্ণকেশী ততক্ষণে টেবিলের কাছে দাঁড়ানো। পরিচয় করিয়ে দেয় জিয়াদ, রেবেকা, প্রজেক্টের কাজে পরিচয়, মা বাংলাদেশী, বাবা স্কটিশ। সুন্দর বাংলায় শাড়িতে জড়ানো রেবেকাকে পছন্দ হয়ে গেছে রায়নার। বন্ধুটার একলা জীবনে এত দিনে একটা সঙ্গী এলো মনের মতন। গুট্টুকে নিয়ে রেবেকা খুব ভাবে। ও নিজে অরফান, তাই গুট্টুর মাঝে রেবেকা নিজেকে খুঁজে পায়। কথায় কথায় বেলা গড়িয়েছে। জিয়াদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উবার কল করে রায়না। গুলশানের এদিকটায় সায়মনের অফিস ছিল। চোখটা জ্বালা করে ওঠে। সন্তর্পণে চেনা জায়গাগুলো এড়িয়ে চলে রায়না। কোনভাবেই দেখা হয়ে যাক পুরনো স্মৃতির সাথে চায়না সে। আঁচল মাথায় তুলে যাত্রী ছাউনির দিকে আগায়।
সায়মন অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে, গাড়িটা নষ্ট, উবার পাচ্ছে না, বাসায় আম্মা একা। ভাইয়ারা মুভ করেছে অনেকদিন। আম্মা এবার সত্যি সত্যি সিক। কিন্তু এবার আর কেউ নেই পাশে থেকে যত্ন করার, খাবার খাইয়ে দেবার। একা একাই থাকতে হয় সারাদিন। কষ্ট হয় সায়মনের কিন্তু এই পরিনতি আম্মার নিজের কর্মফল। অফিস কামাই করা সম্ভব না সায়মনের পক্ষে। মাথা ঝাড়তে গিয়ে পাশে বসা রায়নাকে দেখে চমকে উঠেছে, সৃষ্টিকর্তা কি এভাবেই প্রার্থনা শোনেন অনুতপ্ত হৃদয়ের? কতদিন রায়নার আগের অফিসে গেছে, রায়নাদের বাসায় গিয়েছে, কোথাও কোন খোঁজ পায়নি, আর আজ এভাবে হঠাৎ!
–কেমন আছো রায়না। এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।
–ভালো আছি। রায়না অবাক হয়েছে, চোখটাও জলে ভরেছে, কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত, যার কাছে সেই মূল্যহীন ছিল, তার সামনে চোখের একফোঁটা পানিও নষ্ট করার মানে নেই।
–রায়না, কতদিন পর তোমার সাথে দেখা, সেলে ফোন করলে ধরোনি, তোমার অফিসে গিয়েছি, কেউ রেসপন্স করেনি, অার তোমাদের বাসায় গিয়ে জানলাম ঐ বাসা ছেড়ে দিয়েছ।
–আমাকে কি দরকার তোমার, শাড়ি গহনাগুলোও তো দিয়ে এসেছি, আর কি বাকি অাছে বলো, দিয়ে দেব।
–রায়না ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম, জানো, আম্মার নোংরা চেহারাটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার এখন। অথচ, সময় থাকতে বুঝতে পারিনি, তোমাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি রায়না।
— আমার গাড়ি এসছে চলি, আর তোমাকে মাফ করার কিছু নেই, মেরুদণ্ডহীন পুরুষের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। তবে তোমার মাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করব না। আল্লাহ যেন ওনাকে মৃত্যুর আগে হেদায়েত করেন। দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাওয়া রায়নাকে নতুন করে দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে সায়মনের। দৌড়ে যায় যতটা দ্রুত সম্ভব, গাড়িতে ওঠার মুখে রায়নাকে জিজ্ঞেস করে বসে, লোক লজ্জার মাথা খেয়ে,
–রায়না, আমরা কি নিজেদের আর একটা সুযোগ দিতে পারি না? তোমার মতন মেয়ে আমি হয়ত আর কোন দিন পাব না। হাসিতে ভেঙে পরে রায়না, –ভালো থেকো সায়মন। বলে গাড়িতে উঠে যায়। মনে পরছে, কোর্টে নাকি প্রতিটা শুনানীতে সায়মন হাজির থাকত, সাথে ওর মা। যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স চাইত। আর আজকে ওর নিজের মায়ের চেহারাটা নগ্ন হয়ে গেছে দেখে কি সহজে রায়নাকে ফেরত চাইল। আসলেই সায়মন একটা নপুংসক লোক। কে জানে, ঘোর কেটে গেলে, আবারো হয়ত রায়নাকে ছুড়ে ফেলত!
ধুমধাম করে ছেলে বিয়ে দিয়ে ভীষণ খুশি সাবেরা। এবার ঘর বোঝাই জিনিষপত্রের সাথে মেয়েটাও কচি। মামুন, মনামী শুধু অনুষ্ঠানে এসেছে। আহমেদ সাহেব বিয়ের কাজ শেষ হওয়া মাত্র ওমরাহ্ করতে গিয়েছেন। এবারের চাওয়া সায়মনের সুন্দর জীবন, আর সাবেরার হেদায়েত। আল্লাহর দরবারে নাকি আর কোন চাওয়া নেই ওনার। ভেবেই সাবেরা মুখ টিপে হাসেন। বুদ্ধিতে কেউ কোনদিন পাল্লা দিতে পারেনি তার সাথে। এবার আর বাসর রাতের পরদিন রুমে ঢোকেননি ছেলের। সময় নিচ্ছেন, ধীরে ধীরে সাপ মারবেন। সায়মনকে অবেলায় গোসল করতে দেখে আঁতকে ওঠেন সাবেরা।
–বাবা, তোর ঠান্ডা লাগার ধাত, এই বেলায় গোসল করলি?
–মা, আপনার বিবাহিত ছেলে কখন গোসল করবে, এটাও কি আপনার পারমিশন নিয়ে করবে? ওতো এখন ফিডার খায় না, যে সব আপনি বলে দেবেন আর করবে।
-তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ? দেখলি সায়মন, তোর বউ আসতে না আসতেই তোকে দখল করে নিয়েছে, আমার কোন দাম নেই।
–আম্মা, যুথী যেভাবে বলে, পারলে সেভাবে থাকো। আর আমরা হানিমুনে যাচ্ছি পরশু, ফিরে এসে যুথীর আম্মার বাসায় সরাসরি উঠব। একসপ্তাহ পর ফিরব। দরকারী যা লাগে বাজার করে যাব, আর বেশি সমস্যা হলে ভাইয়াকে কল কর।
–সায়মন, আমি অসুস্থ মানুষ, এতদিন একা থাকব কিভাবে আব্বা? আমাকেও নিয়ে যা, তোদের সাথে।
–আপনি কি মেন্টালি সিক? সায়মন রুমে আসত।
যুথীর পেছন পেছন সায়মনের চলে যাওয়া দেখেন সাবেরা। রাগে গা কিচকিচ করছে তার, তবু কিচ্ছু করার নেই। একা হয়ে গেছেন, ছেলে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে বেশ বুঝতে পারছেন। সায়মন বিয়েরাগে একদিন য়াক্ষেপ করেছিল, রায়নাকে ডিভোর্স দিয়ে বড়। ভুল করেছে। সেদিন সায়মন বেশ তর্কও করেছিল, আর বারবার তাকে দোষ দিয়েছে সংসার ভাঙ্গার জন্য। আর কি যেন বলছিল!, হ্যা, রায়নার কাছে মাফ চাইতে। ছেলের হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে রায়নার কাছে দরকারে মাফ চাবেন সাবেরা। দ্রুত হাতে কল করেন প্রাক্তন পুত্রবধূকে।
দীর্ঘ দিনের অনভ্যস্ততায় নাম্বারটা অচেনা, তাই কলটা রিসিভ করে রায়না, আর তারপরই বিরক্ত হয়। এই জঘন্য মহিলাটার গলা শুনতে হল কেন আবার।
–রায়না মা, ফোন কেটো না মা।তুমি ছাড়া আমার আর কোন গতি নেই, সায়মন তোমার কাছে মাফ চাইতে বলেছে, ছেলে আমার একদম আমাকে বিশ্বাস করে না মা, তুমি আমাকে মাফ করেছ, বল? আমার সাথে কথা বলে একটু সায়মনকে ফোন দিও মা আমার, লক্ষী না মা তুমি, দেখ, তোমরা নিজেরা কি করলে না করলে, ডিভোর্স ও নিলে, আমার দোষ কোথায় বলো তো। মা, একটু সায়মনকে ফোন করে বলো, আমি মাফ চেয়েছি তোমার কাছে। আমার মত অসুস্থ মানুষের এই শেষ অনুরোধ তোমার কাছে, অনুরোধটা রাখবে মা?
রায়না স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, সায়মন বিয়ের কার্ড পাঠিয়ে দোয়া চেয়েছিল। ফোন করেছিল অনেকবার। আজকে প্রাক্তন শ্বাশুড়ির ফোন পেয়ে বুঝতে পারে, সায়মন নিজের ভুল বুঝতে পেরে হয়ত এবার নিজের মাকে সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছে নতুন জীবনের প্রতি পদক্ষেপে। হাসি পায় এবার রায়নার। জোর গলায় জোরে হেসে ফোনটা কাটার আগে সাবেরা আহমেদকে উত্তর দেয়,
–সময় থাকতে সামান্য একটু ভালো আচরণ করতে পারেননি যার সাথে, আজকে তার পায়ে ধরে অনুরোধ করছেন? আচ্ছা বেহায়া মহিলা তো আপনি। দুঃখিত, রাখতে পারছি না আপনার অনুরোধ। আপনি বা সায়মনের জন্য আমার এক বিন্দু অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।
সাবেরার বারবার ডাকের মুখে ফোন কেটে, নাম্বারটা ব্লক লিস্টে দেয় রায়না। একটা লম্বা ছুটির ট্রিপে যাচ্ছে সে, জিয়াদ, রেবেকা, গুট্টু আর মাকে সাথে নিয়ে। জীবনটা কেবল সংসার আর সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে দেয়া ছাড়াও সবল সফল মানুষ হিসেবে এবার বাঁচবে রায়না। আর অপেক্ষা করবে, সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুরোধের ফরিয়াদ জানাবে, একটা সত্যিকারের আপন মানুষ পাবার, যে মানুষটা কেবলি ভালোবাসবে দোষেগুনে মেলানো মানবীকে, রায়নাকে, ততদিন নিজের মত, মুক্ত বিহঙ্গের ডানায় চেপে বাঁচতে চলেছে রায়না, ভালোবেসে নিজেকে।
সমাপ্ত
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা